‌বিষ্ণুপুরের সেনবাড়িতে মা সারদা

ত্রিদিব চক্রবর্তী

বিষ্ণুপুর স্টেশন। কাঠালবৃক্ষ। আর তারই নিচে এক বেদিতে বসে আছেন শ্রীশ্রী মা সারদা। দীন দুঃখি, কুলি মজুরেরা ঘিরে রয়েছেন মা–‌কে। ট্রেন ছাড়ার সময় আসতেই সম্মিলিত কণ্ঠে সকলে জয়ধ্বনি করে উঠলেন— ‘‌জানকী মাই কি জয়।’‌ কিন্তু হঠাৎই ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। যেন কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। থাকার কথাও নয়। কোত্থেকে এক বিহারী কুলি আচমকাই ছুটে এলেন মায়ের কাছে। বলে ওঠেন, ‘‌তু মেরি জানকী, তুঝে ম্যায় নে ইতনে দিনোসে খোঁজা থা, ইতনে রোজ তু কাঁহা থি।’‌ এই বলেই তিনি অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলেন। মা তাঁকে শান্ত করলেন। এবং একটি ফুল সংগ্রহ করে আনতে বললেন। তৎক্ষণাৎ তিনি একটি ফুল এনে মায়ের পাদপদ্মে অর্পণ করলেন। মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে মা সেই কুলির মনস্কামনা পুর্ণ করলেন। কিন্তু সেই কুলির পরিচয় আজও অধরাই। রেলের রেজিস্টারেও না। তবে কি সেদিন কুলিবেশী ভক্তটি স্বপ্নে বা অন্য কোনও অবস্থায় শ্রীমাকে সীতামাতারূপে দর্শন করেছিলেন!‌ দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাকে খুঁজছিলেন?‌ এরকম কত ঘটনার কথাই তো উঠে আসবে। কত স্মৃতি, কত আবেগ জড়িয়ে আছে মল্লভূমে, একশো বছর পরেও। যার পরতে পরতে সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস। যেন সবই নীরবে পাঠ করে চলেছে বিষ্ণুপুর। রোমাঞ্চিত সেই ইতিহাসের, সেদিনের কথা।

গানবাজনা, মোতিচুরের নাম শুনলেই উঠে আসে বিষ্ণুপুরের নাম। আবার শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থানও বলা হয়ে প্রাচীন এই শহরকে। সেই কবেকার কথা। বৈষ্ণব ভাবধারার ঢেউ, তাও পড়েছিল এখানে। বীর হাম্বিরের রাজত্বকালে মল্লভূমে দেবদেউলের কথা তো অনেকেই জানেন। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের জন্য এই গৌড়বঙ্গে এসেছিলেন বৈষ্ণবাচার্য শ্রীনিবাস। মল্ল রাজধানী থেকে মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর। কত নামেই তাকে ডাকা হয়। আর এসব দেখেই শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহাংসদেব বিষ্ণুপুরকে বলেছিলেন গুপ্ত বৃন্দাবন। এ বিষয়ে সহধর্মিনী মা সারদার সঙ্গে আলাপও করেছিলেন ঠাকুর। বলেছিলেন, ‘‌বিষ্ণুরপুরে গুপ্ত বৃন্দাবন আছে। তুমি দেখো।’‌ মা সারদা এই কথা শুনে ঠাকুরকে বলেছিলেন— ‘‌আমি মেয়ে মানুষ। কী করে দেখব?‌’‌ পরবর্তীকালে এই গুপ্ত বৃন্দাবনে পদধূলি পড়েছিল মা সারদার। বিশ্বজননী মা এসেছিলেন এবং এসেছিলেন। একবার নয়, একাধিকবার। প্রথমবার কবে এসেছিলেন?‌ তথ্য বলছে, সময়টা ছিল ১৯০৫। বিষ্ণুপুরের ওপর তখন বেঙ্গল নাগপুর রেলপথ চালু হয়েছে। কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে চেপে বিষ্ণুপুর। সেখান থেকে জয়রামবাটী। পরমহংসদেবের মুখনিসৃত সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। বিষ্ণুপুরের লালবাঁধ পাড়ের সর্বমঙ্গলার মন্দির প্রাঙ্গণে বসে মা সারদা বলে উঠেছিলেন, ঠাকুরের কথাই আজ সত্যি হল।
শুধুই কি ট্রেনে আসা?‌ জয়রামবাটী থেকে বিষ্ণুপুরের দূরত্ব ২৫ কিমি। মা আসতেন গরুর গাড়ি করে। কখনও পালকিতে। আর তাঁর আসা–‌যাওয়ার পথে পোকাবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধের চটিতে নিতেন বিশ্রাম। আট চালায় বসে খেতেন মুড়ি, তেলেভাজা। জীবনের শেষের দিকের বেশ কিছুটা সময় কেটেছে এই বাঁকুড়া জেলাতেই। বিষ্ণুপুরের সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল নিবিঢ়।

সেন বাড়ির ইতিহাসের কথা আমরা কজন জানি!‌ জেলার মানুষদের কথা বাদই দিলাম। বিষ্ণুপুরের মানুষের কাছেও —বিপুলা এই পৃথিবীর মতোই। মায়ের পদধুলিতে স্মৃতিধন্য এই বাড়িতে গেলেই, আজও যেন শোনা যায় মায়ের কণ্ঠস্বর। তবে এসবই ভক্তি ও ভাবের নস্টালজিয়া। দক্ষিণমুখী বারান্দা–‌সহ সেই কোঠাবাড়ি। গ্রামীণ আচ্ছন্নতায় ঢাকা। বিষ্ণুপুরের গড়দরজার পিচরাস্তার গা ঘেসে মোরাম বিছোনো পথ দিয়ে হাঁটলেই দেখা মিলবে সেই বাড়ির। গাছগাছালিতে ঘেরা লম্বা উঠোন। এ বাড়িতেই পদধুলি পড়েছিল মায়ের। একটু পাথর চরণ স্পর্শ পেয়েছিল মা সারদার। উঠোনের তুলসী মঞ্চের গা ঘেসেই রাখা আছে তাকে। সেন বাড়িতে গেলেই দেখা মিলবে তারও। ভক্তদের কাছে এই সেনবাড়িই হয়ে উঠেছে তীর্থস্থান। দশকের পর দশক কেটে গেছে। সাল পেরিয়ে মাস। মাস পেরিয়ে বছর। অক্ষত সেই বাড়ি, সেই পাথর। কথিত আছে, ১৯১৬ সালে ৮ জুলাই এই সেনবাড়িতেই সারাদিন থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেন মা। কোঠাঘরের দোতলায় কাঠের সিংহাসনে মা সারদাদেবী, এই ঘরেই শ্রী শ্রী ঠাকুরের ফটো স্থাপন করে নিজের হাতে পুজো করেছিলেন। শোনা যায়, এই সেনবাড়িতেই শেষবারের মতো দুদিন রাত্রিবাসও করেছিলেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫–‌২৬ ফেব্রুয়ারি।

সেনবাড়ির কথা উঠলেই ভেসে আসে সুরেশ্বর সেনের নাম। তাঁকে মা বলতেন দ্বিতীয় গিরীশ। অশোক কুমার বিশ্বাসের লেখা একটি বইয়ে বলা হয়েছে, শেষবার যখন মা সারদা বিষ্ণুপুরে এসে কলকাতার উদ্বোধনের উদ্দেশে রওনা হন, সেটা ছিল ১৯২০–‌র ২৭ ফেব্রুয়ারি। রাত্রি ৯টায় পৌঁছেছিলেন কলকাতার উদ্বোধনের বাড়িতে। স্বামী সাররদানন্দের একটি লেখা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৯১৭ সালে বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ ২২ মাইল পথ অতিক্রম করে বিষ্ণুপুরের সুরেশ্বর সেনের বাড়িতে পৌঁছে তিনি দেখেন, মা সারদাদেবী একটি বড় জলচৌকিতে বসে রয়েছেন। তাঁর পা দু–‌খানা জলভর্তি একটি গামলায় ডোবানো। সারদা মায়ের পা ধোয়ানোর পরে তাঁকে উপরের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। কলকাতা থেকে ফেরার পথে বিষ্ণুপুর হয়ে জয়রামবাটিতে। আবার জয়রামবাটী থেকে কলকাতা যাওয়ার পথেও মা সারদাদেবী এই সেনবাড়িতেই উঠতেন। সুরেশ্বর সেন সহ সেনবাড়ির সকলেই হয়ে উঠেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য। মঠের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল বিষ্ণুপুরের সেনবাড়ির। ঘরের চালার বারান্দায় বসে মা সারদা দেবী বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে দুপুরের আহার করেছিলেন। সেনবাড়িতে রাখা আছে সেই ছবি। এই সেনবাড়িতেই মা সারদাদেবী এসেছিলেন ৬ বার। কোনওদিন একবেলা, কোনওদিন দুবেলা। আর শেষবার তো ছিলেন টানা দুদিন। বশীশ্বর সেন, ওরফে বশী সেন ছিলেন এই সেনবাড়িরই কৃতি সন্তান। দেশের অন্যতম প্রথিতযশা কৃষিবিজ্ঞানী। সবুজ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত। শ্রী রামকষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। স্বামী লোকেশ্বরানন্দ বশী সেনের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে ‘‌মেমোরিজ অফ এ সায়েন্টিস্ট ডিভোটি’‌ রচনায় লিখেছেন, বশী অনেকবার পবিত্র মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রথম সাক্ষাৎ থেকেই তাঁর স্নেহ জয় করতে পেরেছিলেন। মা একবার জয়রামবাটীতে যাওয়ার পথে তাঁর গ্রামের বাড়িতেও কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। এটি তাঁর পরিবারের প্রতি তাঁর স্নেহের একটি পরিমাপ ছিল। এমনকী মা সারদা সুরেশ্বরবাবুর ছেলেকে লক্ষ করে বলেছিলেন, এখানে তোমার বাবা ছিলেন (‌গুপ্ত মহারাজ)‌। আমি এসেছি। এইসব যা দেখছ, তার রাস্তা তো গুপ্তই খুলে দিয়েছে। সেই কারণেই পরিবারের সকলেই হয়ে উঠেছিলেন শ্রীমা ও স্বামীজির অন্যতম ভাবানুরাগী। সেনবাড়ির এক বর্তমান সদস্যের কাছেই জানা গেল, স্মৃতিবিজড়িত কোঠাঘরটির কথা। এখন যা তালাবন্ধই থাকে। কেউ এসে দেখতে চাইলে তবেই খোলা হয় গৃহটি। তবে পুজোপাঠ হয় রোজই। পরিবারের কেউ সেখানে থাকেন না। অন্যান্য দেবদেবীদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও মা সারদার ছবিকে সিংহাসনে রাখা হয়েছে।

পরিবারের এক সদস্যের কাছে জানা গেল, কোঠাঘরটির নিচের তলায় জল চুঁইয়ে পড়া দেখে মা সারদা ফাটল স্থানটির ওপর হাত বুলিয়ে দেন। কী অদ্ভুত লীলা। ব্যাস, তারপর থেকেই জলপড়া বন্ধ। তবে এটা জনশ্রুতিও হতে পারে। এরকম কত ইতিহাসেরই সাক্ষী এই সেনবাড়ি। প্রসঙ্গত, স্বামী বিবেকাননদের প্রথম শিষ্য স্বামী সদানন্দ (‌গুপ্ত মহারাজ)‌ ১৩১৫ সালে বিষ্ণুপুরে এসে এই বাড়িতে ২ মাস কাটিয়ে যান। বিষ্ণুপুরের গড়দরজা স্থিত পরমেশ্বর সেনের বাড়িতেও এসেছিলেন মা সারদা। বর্তমানে সেটি রামকৃষ্ণসারদা তীর্থম নামে পরিচিত। এই বাড়িতে মা সারদা একবার এসেছিলেন। জয়রামবাটী মাতৃমন্দিরের প্রাক্তন সন্ন্যাসী ভোলা মহারাজ (‌বিশ্বেশ্বর সেন)‌ বর্তমানে এই কুটিরেই বসবাস করেন। তাঁর মুখেই শোনা গেল এ বাড়ির আরেক ইতিহাসের কথা। মা যখন এসেছিলেন এই গৃহে, তখন রাস্তা সংকুলানের জন্য লাল শালুতে মোড়া রাস্তার ওপর পায়ে হেঁটেই মা সারদা প্রবেশ করেছিলেন। বিশ্রামও নিয়েছিলেন। কাছেই রাখা ছিল গরুর গাড়ি। গাছগাছালিতে ঘেরা টিনের চালাঘরটি আজও অক্ষত রয়ে গেছে।

আমরা কি সত্যিই ইতিহাসকে সংরক্ষণে আগ্রহী?‌ প্রশ্ন থেকেই যায়। বিষ্ণুপুরের স্থানীয় মানুষজন তো বটেই, প্রশাসনিক সংশ্লিষ্ট স্তরেও অদ্ভুত এক উদাসীনতা।‌ শ্রীশ্রী মা সারদার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিকে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করলে বাড়িটির করুণ ও শ্রীহীন দশা অনেকটাই কাটবে। অগণিত সাধারণ ভক্তপ্রাণ ও পুণ্যার্থী মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে যথাযোগ্য মূল্যও দেওয়া যাবে। এখনও যদি আমরা উদাসীন থাকি, শতবর্ষ অতিক্রান্ত গৌরবময় ইতিহাস অচিরেই অবলুপ্তি ও বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। বাড়ি সংলগ্ন রাস্তার সম্প্রসারণ জরুরি। পাশাপাশি, বশীশ্বর সেনও তো নিজের জগতে একজন কিংবদন্তি। জেলার, তথা রাজ্যের গর্ব। তাঁর বিজ্ঞান সাধনা ও অন্যান্য সামাজিক দিক তুলে ধরাটাও তো জরুরি। নইলে, আগামী প্রজন্ম বাঁকুড়ার গৌরবগাথার সঙ্গে পরিচিত হবে কীভাবে?‌

প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক বিষ্ণুপুরে ভ্রমণ করলেও এরকম একটি পুণ্যস্থান দর্শন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রচারের অভাবেই। তাই পর্যটন বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, এ বিষয়ে একটু উদ্যোগী হোন। সেনবাড়িটিকে ঘোষণা করা হোক হেরিটেজ বিল্ডিং রূপে। যেখানে গেলে মায়ের ব্যবহৃত গৃহটিকে দেখার ও শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ হবে। সেন বাড়ির বর্তমান সদস্য শান্তনু সেনকেও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। সর্বোপরী সরকারি আনুকূল্যে এবং রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের সাহায্য পেলে শ্রী মায়ের এই পুণ্য গৃহটি আবার স্বমহিমায় বিরাজ করবে।

তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার:‌ ভোলা মহারাজ (‌বিশ্বেশ্বর সেন)‌, হরিপ্রসন্ন সিংহ (‌শিক্ষাবিদ)‌, উদয় মণ্ডল, শান্তনু সেন। ‌‌‌‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *