সহজ কথা যায় না বলা সহজে

মিডিয়া সমাচার

সরল বিশ্বাস

‌নামটা ভারী সুন্দর। সহজ কথা। অনেকটা যেন সহজ পাঠের মতোই। অকারণ উত্তেজনা নেই। পাণ্ডিত্য ফলানোর চেষ্টা নেই। ডেকে আনা অতিথিকে বসিয়ে রেখে নিজে বকবক করে যাওয়া নেই। একেবারে ভিন্ন স্বাদের একটা অনুষ্ঠান। অবশ্য অনুষ্ঠান না বলে খোলামেলা আড্ডা বলাই ভাল।

গত দু’‌তিন বছরে বেশ কিছু পডকাস্ট চ্যানেল এসেছে। বাংলাতেও অনেকেই এই প্যারালাল মিডিয়াকে আশ্রয় করে নিজের প্রতিভা মেলে ধরছেন। একেকটা অনুষ্ঠানের চরিত্র একেকরকম। কোথাও খবর, কোথাও বিনোদন, কোথাও সাহিত্য, কোথাও খেলা, কোথাও আবার ভ্রমণ। কিন্তু সহজ কথা একেবারে অন্য ঘরানার অনুষ্ঠান। এর সঞ্চালক রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। নামটা বেশ ভারী ভারী লাগছে। আসলে, বাংলা সিনেমায় আমরা রাহুল বলতে যাঁকে বুঝি, তিনিই।

প্রথম ছবিতেই একেবারে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তবে তিনি দেব বা জিৎ গোত্রের নন। মারকাটারি হিরো বলতে যা বোঝায়, তা একেবারেই নন। চোখেমুখে একটা বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাপার আছে। অভিনয়ের সময় চিত্রনাট্যকারের লেখা স্ক্রিপ্ট তাঁকেও বলতে হয়। কিন্তু তাঁর নিজের ভেতর অনেক চিত্রনাট্য জন্ম নেয়। পড়াশোনার ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। রাজনৈতিক অবস্থানও স্পষ্ট। কাউকে অকারণ আক্রমণ না করেও সুন্দরভাবে নিজের বক্তব্য মেলে ধরা যায়, তিনি সেটা বেশ কয়েকবছর ধরেই বুঝিয়ে আসছেন। আর যাই হোক, তিনি ঝাঁকের কই নন।

সেই রাহুল যদি পডকাস্ট চ্যানেল খোলেন, একটা প্রত্যাশা তৈরি হওয়ারই কথা। এমন হুজুগ অনেকেরই হয়। কিন্তু সেই হুজুগ মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। লোকে দেখছে না, ভিউয়ার তৈরি হচ্ছে না, নামীদামি লোকেরা আসছে না, এমন নানা কারণে হতাশা আসে। তখন ‘‌রইল ঝোলা চলল ভোলা’‌ করে রণে ভঙ্গ দেওয়াই দস্তুর। কিন্তু রাহুলের সহজ কথা মোটেই তেমন চ্যানেল নয়। ভিউয়ার তৈরির জন্য অকারণ চাঞ্চল্য তৈরির পেছেনে ছোটে না। জোর করে বিতর্ককে উস্কে দেয় না। বরং চেনা মানুষকে হাজির করে একেবারে অচেনা আঙ্গিকে।

ধীর, স্থির সহজ লয়ে কথা বলা। রাহুলের কথা বলার ভঙ্গিটা বেশ আন্তরিক। একেবারে বৈঠকী গল্পের আমেজ। অতিথি নির্বাচনের ব্যাপারেও বেশ যত্নশীল। কেউকেটা কাউকে ডেকে ফেললাম, আর একগুছ বিতর্কিত প্রশ্ন প্লেটে সাজিয়ে দিলাম, এমন গোত্রের নয়। যাঁকে অতিথি করে আনছেন, তাঁর সম্পর্কে রীতিমতো রিসার্চ করছেন। তাঁর কাজকর্মের ধারার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু প্রচলিত প্রশ্নের বাইরে অন্যরকম বিষয় তুলে আনছেন। সেই অতিথিও যেন বেশ সাচ্ছন্দ্য এমন আড্ডা দিয়ে।

আচ্ছা, এই মুহূর্তে টলিউডের কজন অভিনেতা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সাহিত্য নিয়ে দেড় ঘণ্টা আলোচনা করতে পারেন?‌ এই পর্যায়ের লেখাপড়া কজনের আছে?‌ শীর্ষেন্দুর একটা উপন্যাস পড়েছেন, টলিউডে এমন লোক এখন খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। কে আসল পাঠক আর কে ওপর চালাকি করছে, লেখক ঠিক বোঝেন। রাহুলের আড্ডায় যেন ধরা দিলেন অন্য এক শীর্ষেন্দু।

সিনেমার জগতের লোকজন আসবেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অভিনেতা বা পরিচালকের এমন অনেক অজানা দিক, অজানা গল্প থাকে, যা আমজনতা জানেন না। এমনকী চিত্র সাংবাদিকরাও জানেন না। ফলে, তাঁদের প্রচিলত ইন্টারভিউয়ে এইসব কথা উঠে আসে না। রাহুল শুধু একবার সূত্রটা ধরিয়ে দেন। তারপর নদী বইতে থাকে আপন খেয়ালে। কাউকে অকারণ তোল্লাই দেওয়াও নয়, আবার প্যাঁচে ফেলার মতো জটিল প্রশ্নও নয়। তার মাঝামাঝি একটা রাস্তা। সহজিয়া মেঠো পথ।

সহজ নামটার প্রতি রাহুলের একটা দুর্বলতা থাকারই কথা। কিন্তু অনুষ্ঠানটা সহজ–‌সরল রাখা খুব সহজ ছিল না। যেমন, একবার ডেকে আনলেন ট্যুর ভ্লগার শিবাজি গাঙ্গুলিকে। সঙ্গী পৃথ্বীজিৎ। ভ্রমণের কত অজানা দিক উঠে এল সেই মুখোমুখি আড্ডায়। যাঁরা বেড়াতে ভালবাসেন, তাঁদের কাছে যেন অমূল্য সঞ্চয়। অন্য কোনও পডকাস্টার এভাবে শিবাজিকে ডেকে এনে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিসরকে এভাবে তুলে ধরার কথা হয়তো ভাবতেই পারতেন না।

এভাবেই এগিয়ে চলেছে রাহুলের সহজ কথা। চলতে থাকুক, ঠিক এভাবেই চলতে থাকুক। বাঙালি পড়তে ভুলে গেছে। অন্তত শুনে সেই ঘাটতিটা কিছুটা পূরণ করুক। ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *