গল্প
সৌর্য সিনহা
ডুয়ার্সের আকাশে ভোরের নরম আলো। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা কুয়াশা তখনও পুরোপুরি সরেনি। রাজাভাতখাওয়ার ছোট্ট স্টেশনটা যেন অন্য এক সময়ের গল্প বলে। সবুজে ঘেরা, প্রায় নির্জন, দূরে চা–বাগানের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় কুঁড়ে–ঘর। ট্রেন দিনে কয়েকবার মাত্র থামে। তবু স্টেশনের লালচে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে অর্ণবের মনে হয়, যেন কোনও অজানা কবিতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
জয়িতা পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, ‘তুমি বড্ড আবেগপ্রবণ, অর্ণব। একটা স্টেশনকেও কবিতা ভেবে ফেলছো!’
অর্ণব মৃদু হাসল। সে সাহিত্যের শিক্ষক, কথায় কথায় রূপক খুঁজে নেয়। জয়িতা ইঞ্জিনিয়ার, তার আবার এত আবেগ নেই। সে বোঝে ডেটা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, দুজনের দাম্পত্য জীবন মন্দ যাচ্ছে না। কিন্তু কোথাও কোথাও যেন অদৃশ্য একটা দূরত্ব রয়ে গেছে।
রাজাভাতখাওয়ায় কাটল কয়েকটা দিন—অলস দুপুর, বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা, নির্জন স্টেশনে বসে থাকা। স্টেশনটা বেশ অদ্ভুত। চারপাশে জঙ্গল। মাঝখানে যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তিক এই স্টেশন। স্টেশনের পাশেই একটা ভাতের হোটেল। দোকানের মালিককে সবাই বুলুদা বলে। সবসময় হাসিমুখ। আপাদমস্তক একজন সরল মনের মানুষ। কোনও প্যাঁচালো ব্যাপার নেই। টুরিস্টদের সঙ্গে দিব্যি গল্প জুড়ে দেয়। হাতির নানা কর্মকাণ্ড বলে যায়। বুলুদার দোকানের পেছনে ওর দাদা পরিমলের হোম স্টে। সেই হোম স্টে–র পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা ঝোরা। দিব্যি স্নানও করা যায়। ঝোরার ওপারেই জঙ্গল।
স্টেশনের আরেক পাশে জঙ্গল লজ। নামের শেষে লজ থাকলেও মোটেই প্রাইভেট নয়। এটা বনদপ্তরের বাংলো। যে কেউ বুকিং করতে পারে। অর্ণবরা আপাতত সেখানেই উঠেছে। বিশাল এলাকাজুড়ে এই বাংলো। পাশেই একটা কাঠের বাংলো। লিও কটেজ। আপাতত পরিত্যক্ত। করোনার সময় এখানেই কয়েকজনকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। তারপর থেকে আর সংস্কার হয়নি। কিন্তু এই বাংলোর উপরের বারান্দায় বসে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকার রোমাঞ্চই আলাদা।
অর্ণবের কিন্তু বেশ ভালই লাগছে। দুজন মিলে আপনমনে লিও কটেজের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ইচ্ছেমতো চায়ের দোকানে বসে পড়ছে। জয়িতা গুনগুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা এখানে নেই। এই আলস্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতোই।
তারপর তারা গেল বক্সায়। বক্সা যাওয়াটা অবশ্য তাদের ট্যুর প্ল্যানের মধ্যে ছিল না। বুলুদার মুখে এই দুদিন বক্সা পাহাড়ের এত গল্প শুনেছে, জয়তীই জেদ ধরল, চলো, এতদূর যখন এসেছি, সেই দুর্গ দেখেই যাই।
দুই
অটো রিজার্ভ করে ওরা গেল সান্তালাবাড়ি পর্যন্ত। সেখান থেকে পায়ে হেঁটেই উঠতে হবে। পাহাড়ি রাস্তা, আঁকাবাঁকা পথ, চারপাশে ঘন অরণ্য। মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে যাচ্ছে। উঁচু পাথরে একটু করে জিরিয়ে নেওয়া। ওদের পাশ কাটিয়ে কেউ উঠছে মাথায় গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে। কারও মাথায় আবার ইয়াব্বড় ব্যাগ। এত দুর্গম জায়গায় ওরা রোজ এভাবে ওঠে!
অর্ণব–জয়িতা যখন উঠছে, তখন কেউ কেউ আবার নেমেও আসছে। অর্ণব মাঝে মাঝেই জানতে চাইছে, আর কত দূর? এক মাঝবয়সী যুবক বলে উঠলেন, ‘দাদা, দিল্লি বহুদূর। সবে তো তিরিশ পারসেন্ট এসেছেন। এখনও সত্তর পারসেন্ট বাকি।’ বড্ড বেআক্কেলে লোক। আরে বাবা, তুই না হয় উঠেছিস। তাই বলে লোককে এভাবে ডিমোটিভেট করার কোনও মানে হয়!
পেছন থেকে নেমে আসছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। বয়স অন্তত পঁয়ষট্টি তো হবেই। উনি এসে কিছুটা ভরসা দিলেন, ‘ইয়ং ম্যান, আমি পারলাম, আপনারা পারবেন না? ঠিক পারবেন। এতদূর যখন এসে পড়েছেন, তখন ফিরে যাবেন না। একটু হয়তো কষ্ট হবে। কিন্তু বক্সা বিজয়ের আনন্দই আলাদা। আজ ফিরে গেলে এই আনন্দ থেকে সারাজীবন বঞ্চিত থেকে যাবেন।’
বৃদ্ধের কথায় কিছুটা যেন ভরসা পেল অর্ণব–জয়িতা। অর্ণব তবু একবার জয়িতার দিকে তাকাল। ইঙ্গিতে জানতে চাইল, পারবে তো? জয়িতা বলে উঠল, ‘চলো ইয়ং ম্যান, সবাই যখন পারছে, আমরাও পারব। তাছাড়া, এলাম যখন, মাঝপথে ফিরে যাব কেন?’
উঠতে উঠতেই অর্ণবের মনে পড়ে গেল, এই বক্সায় দীর্ঘদিন বন্দি ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘মেঘের গায়ে জেলখানা’ শিরোনামে চমৎকার একটা লেখা লিখেছিলেন। স্বাধীনতার আগে এখানেই বিপ্লবীদের বন্দি রাখত ইংরেজরা
ওই তো, একটা ভাঙাচোরা দুর্গ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, ওরা কাছাকাছি এসেই গেছে।
তিন
অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। হঠাৎ একটা দোকান চোখে পড়ল। বাঁশের টেবিল। বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা।
দুজনেরই মনে হল, একটু জিরিয়ে নিলে মন্দ হয় না। সেই সান্তালাবাড়িতে কয়েকটা মোমো খেয়েছে। সে তো কখন হজম হয়ে গেছে। মেনু কার্ডে চোখ বোলাতে গিয়ে যেন কিছুটা বিস্ময়। মোমো, নুডলস, চিকেন পকোড়া, ফ্রায়েড রাইস— প্রায় সবই পাওয়া যাচ্ছে। চা, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস তো আছেই। এমন দুর্গম জায়গা, যেখানে কোনও গাড়ি ওঠে না, সেখানের এক ছোট্ট ঝুপড়ি দোকানেও কিনা এত খাদ্যের সম্ভার! দামও বেশি নয়, সমতলের মতোই। ওরা ম্যাগি আর কফি অর্ডার করল। জয়িতা বলল, ডিম সেদ্ধ হলে কেমন হয়! জয়িতা যতই কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করুক, এই ডিম সেদ্ধ নিয়ে অদ্ভুত একটা দুর্বলতা আছে, সেটা অর্ণব জানে। তাই দুজনের দুটো নয়, বরং চারটে ডিমের কথা বলল। জয়িতার হাসিতেই বোঝা গেল, তার বেশ সমর্থন আছে। চারটে করে আটটা ডিম বললেও বোধ হয় আপত্তি করত না।
খাওয়া পর্বের মাঝেই ওই মাসির কাছে দুর্গের ইতিহাস জানতে চাইল। মাসি বললেন, ‘এখানে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসকেও বন্দি রাখা হয়েছিল। সেই সেলটা এখনও আছে।’ শুনেই যেন গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল অর্ণবের। এখানে নেতাজি বন্দি ছিলেন! সত্যিই, না এলে অনেক আক্ষেপ থেকে যেত।
দুর্গে সংস্কারের কাজ চলছে। জয়িতা বলল, ‘রেনোভেশন হচ্ছে, ভাল কথা। কিন্তু ভয় হয়, এটাকেও পাছে কংক্রিটের জঙ্গল না বানিয়ে দেয়। এখানেও টাইলস না বসিয়ে দেয়!’
একে একে সেলগুলো ঘুরে দেখল। একজন গাইড অন্যান্য টুরিস্টদের বুঝিয়ে চলেছেন বক্সার ইতিহাস। তিনিও বললেন, এই সেলে নেতাজি বন্দি ছিলেন। লোহার গরাদের তলা দিয়ে খাবার দেওয়া হত। ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে এই জেল থেকে তিনি পালিয়েছিলেন। ভুটানি সেপাইরা নেতাজিকে ঘোড়ায় চাপিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
অর্ণব বুঝল, গাইড মশাই বিস্তর জল মেশাচ্ছেন। গল্পের গরুকে গাছে তুলে দিচ্ছেন। এটুকু অতিরঞ্জন ক্ষমা করে দেওয়াই যায়। জয়তি একটা পাথরের টুকরো নিয়ে ব্যাগে ভরল। নেতাজির সেলের কিছু স্মৃতিচিহ্ন সে বয়ে নিয়ে যেতে চায়।
চার
একটু দূরেই একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে নাকি হেলিপ্যাড ছিল। হেলিকপ্টারে আসতেন ব্রিটিশ সাহেবরা। সেখানেও বেশ কয়েকজন টুরিস্ট। কেউ সেই হেলিপ্যাডের ছবি তুলছেন। কেউ আবার হেলিপ্যাডকে পেছনে রেখে সেলফি তোলায় ব্যস্ত।
দূর থেকে এক মহিলাকে দেখে অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে কি সত্যিই পর্ণশ্রী? কলেজ জীবনের পরিচিত মুখ?
ছবি তোলার ফাঁকে পর্ণশ্রীরও নজর এড়ায়নি। সেও বুঝতে পারল, এ ঠিক অর্ণব। আর অর্ণব যেভাবে তার দিকে তাকাচ্ছিল, তাতে সে আরও নিশ্চত হল।
তবু প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘অর্ণব?’
যাক, অর্ণবেরও আর সংশয় রইল না। এ সেই হারিয়ে যাওয়া পর্ণশ্রী। ফেসবুকে মাঝে মাঝেই খুঁজেছে। কিন্তু বিয়ের পর তার পদবী কী হয়েছে, জানে না। এমন কত পর্ণশ্রী আছে। ফলে, হাল ছেড়ে দিয়েছে।
এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে গেল। অর্ণবের মনে ভেসে উঠল তাদের কলেজের দিনগুলো। দুজনেই জানত, তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের হলেও, টানটা যেন নিছক বন্ধুত্বের চেয়ে কিছুটা বেশিই। কিন্তু সাহস করে কেউই কোনওদিন প্রকাশ করতে পারেনি। দল বেঁধে সিনেমায় গেছে। রেস্তোরাঁয় গেছে। কিন্তু দুজনে মিলে কখনও যাওয়া হয়নি। কেউই কাউকে প্রস্তাবটা দিয়ে উঠতে পারেনি। কখনও পরিস্থিতি, কখনও ভীরুতা, কখনও আবার ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—সবকিছু মিলে সম্পর্কটা যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গিয়েছিল।
আজ এত বছর পর পাহাড়ি বক্সায় হঠাৎ দেখা। দুজনেই একটু অপ্রস্তুত, আবার আনন্দিতও।
জয়িতা তখন কাছাকাছি ছবি তুলছিল। অর্ণব দ্রুত পরিচয় করিয়ে দিল, ‘আমার কলেজ ফ্রেন্ড, পর্ণশ্রী।’ জয়িতা ভদ্র হেসে কথা বলল, কিন্তু তার চোখে সামান্য কৌতূহল টের পেল অর্ণব।
ওদিকে পর্ণশ্রীও হাঁক পাড়ল তাঁর স্বামী রজত ও কন্যা শ্রেয়সীকে। মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, ‘এটা অর্ণব আঙ্কেল। খুব ভাল কবিতা লিখত।’
পর্ণশ্রীর কর্তা জানতে চাইল, লিখত মানে? প্রাক্তন কবি? এখন লেখেন না?
অর্ণবের পাশে থাকা জয়িতা পাল্টা মজা করে বলল, ‘ছেলেদের সব কবিতা বিয়ের পর হারিয়ে যায়। তারা বান্ধবীদের দেখে কবিতা লেখে। বউদের জন্য লেখে না।’
সবাই হো হো করে হেঁসে উঠল।
কথাটা অবশ্য নেহাত মন্দ বলেনি। এখন সে ক্লাসে কবিতা পড়ায় ঠিকই, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও নিজে তো তেমন লিখতে পারে না। কেউ লেখা চাইলে প্রবন্ধ বা ফিচার দেয়। কবিতা তো লেখে না।
পর্ণশ্রীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল। কলেজ, শিক্ষক, পুরনো বন্ধু—সবাইকে নিয়ে। কিন্তু কোথাও একটা অলিখিত দেওয়াল ছিল। তারা দুজনেই জানত, কিছু কথা বলার নয়। একদিকে পর্ণশ্রীর সঙ্গে রজত, অন্যদিকে অর্ণবের সঙ্গে জয়িতা। ফলে ইচ্ছে থাকলেও ফোন নম্বর বিনিময় হল না। এবারও সঙ্কোচে কেউ ফোন নম্বর চাইতেই পারল না। তবে বরের সঙ্গে আলাপের সময় কায়দা করে পদবীটা জেনে নিয়েছে।
সত্যিই কি ফোন নম্বর চাওয়া যেত না? পর্ণশ্রী নিশ্চয় আপত্তি করত না। কী জানি, তাঁর বর হয়তো মনে মনে ক্ষুন্ন হত। কী জানি, জয়িতা হয়তো ভেবে নিত, এরা নিশ্চয় পরে যোগাযোগ করবে। একটা সন্দেহ দানা বাঁধত। তাই এবারেও সঙ্কোচের দেওয়ালটা থেকেই গেল।
পাঁচ
পর্ণশ্রীরা একটা গ্রুপে এসেছিল। তারা নেমে গেল। অর্ণব ইচ্ছে করেই কিছুটা সময় নিল। ফেরার পথে সেই মাসির দোকানে আরও একবার বসল। বক্সারও আরও উঁচুতে আরও একটা গ্রাম— লেপচা খা। সেখানেও নাকি টুরিস্টরা যায়। হোম স্টেও আছে।
বুলুদা বলে দিয়েছিল, পাথুরে রাস্তা। বিকেলের মধ্যে কিন্তু সান্তালাবাড়িতে নেমে যাবেন। নইলে, ওখান থেকে অটো পেতে সমস্যা হবে। সন্ধের দিকে রাস্তায় হাতি বেরোয়। অটো বা টোটোওয়ালারা আসতে চায় না।
বুলুদার কথামতোই বিকেলের আগেই ওরা সমতলে নেমে এল। একটা টোটোয় চড়ে রাজাভাতখাওয়ায় ফিরেও এল। জয়িতা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অর্ণব বারান্দায় বসে রইল একা। চারপাশে ঝিঁঝিঁর ডাক, দূরে নদীর কলতান। আর মনে ভেসে চলল পর্ণশ্রীর মুখ।
সে ফোনটা হাতে নিল। ফেসবুক খুলল। পর্ণশ্রীর পদবী জানা গেছে। এবার হয়তো পাওয়া যাবে। সার্চ বারে লিখল—Parnashree chaki.
চাকি পদবীটা খুব একটা পরিচিত নয়। সেই বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকি আর ভাষাবিদ জ্যোতিভূষণ চাকির পর আর কারও এমন পদবী শোনেনি। রেয়ার টাইটেল হওয়ার এটা একটা সুবিধা। ফেসবুকে খুঁজতে সুবিধা হয়।
হ্যাঁ, প্রোফাইল আছে। ছবিতে প্রায় চেনা যায়, তবু চোখের কোণে বয়সের রেখা স্পষ্ট। তবু যেন সেই চেনা দীপ্তি অটুট। অর্ণব অবচেতনে স্ক্রল করতে লাগল। পুরনো ছবির নীচে তার হাসি, ভ্রমণের অ্যালবাম, কয়েকটা কবিতা–উদ্ধৃতি—সবকিছুই যেন অর্ণবকে টেনে নিয়ে গেল অতীতে।
কিছুক্ষণ পর সে টের পেল—পর্ণশ্রীও তার প্রোফাইল ঘেঁটেছে। নামের পাশে “Viewed your profile” নোটিফিকেশন দেখে বুক কেঁপে উঠল।
তাহলে কি একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রাখবে! পরে মনে হল, কই, পর্ণশ্রীও তো তার প্রোফাইল দেখেছে। সে তো পাঠায়নি। তাছাড়া, পর্ণশ্রীর পদবী বদল হলেও তার তো হয়নি। এতদিন পর্ণশ্রী তাকে সার্চ করেনি কেন? বা সার্চ করলেও রিকোয়েস্ট পাঠায়নি কেন?
তাই, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আর পাঠানোই হল না।
ছয়
অর্ণব বুঝল, এই নীরবতাই আসলে তাদের সম্পর্কের সংজ্ঞা। একসময়ে যা বলা হয়নি, আজও তা বলার সাহস হল না। হয়তো এই নীরবতাই টিকে থাকবে সারাজীবন, কোনও ভারী প্রতিশ্রুতি বা অনুতাপ ছাড়াই।
ভেতরে গিয়ে দেখল, জয়িতা ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। তার চুল এলোমেলো হয়ে গাল ঢেকেছে। অর্ণব ধীরে গিয়ে বিছানায় বসল, তার হাতটা আলতো করে ধরল। জয়িতার ঘুম ভাঙেনি, তবু আঙুল নড়ল।
অর্ণব এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। বুঝল—বর্তমানই তার সত্যি। অতীতের ছায়া হয়তো ফিরে ফিরে আসবে, কিন্তু তাকে বেঁধে রাখবে না।
সাত
পরদিন সকালে আবার তারা হাঁটতে বেরোল রাজাভাতখাওয়ার স্টেশন চত্বর ঘিরে। প্ল্যাটফর্মে সূর্যের আলো পড়েছে, কুয়াশা গলে গেছে।
জয়িতা বলল, ‘আজ এখানকার ছবি তুলব অনেক। ফিরে গিয়ে ফ্রেমে বাঁধাব।’
অর্ণব মুচকি হাসল। দূরে ট্রেন ঢুকছে, ধোঁয়া উড়ছে। তার চোখে ভেসে উঠল পর্ণশ্রীর হাসি, কিন্তু সে আর পিছনে তাকাল না।
জয়িতার হাত ধরে সে হাঁটতে লাগল।
স্টেশনের লালচে প্ল্যাটফর্মে তখন শুধুই নীরবতা, আর অজানা এক কবিতার অক্ষর—যা লেখা হল না, তবু থেকে গেল মনে।
