রূপেশ কুমার
ভারতের সবথেকে দীর্ঘমেয়াদি মুখ্যমন্ত্রী কে? একটা সময় ছিলেন জ্যোতি বসু। কিন্তু নিঃশব্দে তাঁকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই পড়শি রাজ্যের একজন, পবন চামলিং। কিন্তু সবাইকেই কোথাও না কোথাও থামতে হয়। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীকেও থেমে যেতে হয়েছিল। তফাত একটাই, জ্যোতিবাবু স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু চামলিংকে সরতে হয়েছিল জনতার রায়ে।
সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীকেও একজন ছাপিয়ে যেতে পারতেন। তিনি ওড়িশার নবীন পট্টনায়েক। উন্নয়নের নিরিখে দেশের অন্যতম সেরা মুখ্যমন্ত্রী। রাজনীতির আঙিনায় বিরল এক ভদ্রলোক। কিন্তু গতবছর তাঁকেও থেমে যেতে হয়েছে। নিজে জিতেছেন। কিন্তু বিজেডি সরকারের পতন হয়েছে। আর ৬৭ দিন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে থাকলে তিনিই হতেন সবথেকে বেশিদিনের মুখ্যমন্ত্রী।
এই বছর হয়তো আরও একজনকে থেমে যেতে হবে। তিনি নীতীশ কুমার। তাঁর অবশ্য এখনও কুড়ি বছর হয়নি। কিন্তু বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে তিনিই সবথেকে লম্বা রেশের ঘোড়া। প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মাত্র আটদিনের জন্য। ২০০৫ থেকে দুটো টার্ম। মাঝে ৯ মাসের বিরতি। ২০১৫ থেকে আরও দশ বছর। বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে এনডিএ শিবিরে। ২০১৫–তে আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে মুখ্যমন্ত্রী। মাঝপথে হঠাৎ করে জোট বাঁধলেন বিজেপির সঙ্গে। ২০২০ তে বিজেপির সঙ্গে জোটে জেতার পরেও মাঝপথে আবার লালুপ্রসাদের হাত ধরলেন। লোকসভা ভোটের ঠিক আগেই আবার ভাজপা শিবিরে।
বারবার শিবির বদল করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারপরেও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মুখ্যমন্ত্রী বলেই পরিচিত। ব্যক্তিগত আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ নেই। আইনের শাসন যেমন অনেকটাই ফিরেছে, তেমনই বিহার অনেকটাই হেঁটেছে উন্নতির রাস্তায়। দলের মধ্যে পরিবারতন্ত্র আনার চেষ্টা করেননি। প্রশাসকের দায়িত্ব কী, মোটামুটি বোঝেন। কোনটা রাজনৈতিক মঞ্চে বলতে হয়, কোনটা সরকারি মঞ্চে বলতে হয়, এই পরিমিতি বোধ যথেষ্টই আছে। সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা হল মদ নিষিদ্ধ। এখনও সেই বিশ্বাসেই অটল আছেন। দশ বছর ধরে বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মদ থেকে আয়ের সহজ রাস্তায় হাঁটেননি। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্টই সাহস লাগে।
আরও একটা ব্যতিক্রমী কাজ করেছিলেন। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন। সেবার জেডিইউ–র ফল খুবই খারাপ হয়েছিল। নৈতিক দায়িত্ব মাথায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন জিতনরাম মাঝিকে। পরের বছর জনতার রায় নিয়ে আবার ফিরে আসেন। ভারতীয় রাজনীতিতে এমন নজির বিরল। তাই নীতীশ কুমার যেমন বারবার শিবির বদল করেছেন, তেমনই লোকসভা নির্বাচনে খারা ফলের নৈতিক দায় নিয়ে সরেও দাঁড়িয়েছিলেন।
তবু তিনি হয়তো ‘প্রাক্তন’ এর তালিকায় চলে যাবেন। মূল কারণ, বয়স। পঁচাত্তরে পা দেবেন। শরীর আর আগের মতো সঙ্গ দিচ্ছে না। আচরণে কোথাও কোথাও অসংলগ্নতা ধরা পড়ছে। তাছাড়া, পায়ের তলার জমিও আগের মতো শক্ত নয়। আগেরবার তাঁর আসন অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন তৃতীয় শক্তি। তারপরেও বিজেপি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এবার কি সেই উদারতা দেখাবে? পাঁচ বছর আগেই তাঁর আসন কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এবং সেই চেষ্টা হয়েছে জোটসঙ্গী বিজেপির দিক থেকেই। চিরাগ পাসোয়ান বেশ কিছু জায়গায় প্রার্থী দেওয়ায় নীতীশ কুমারের দলকে বেশ কিছু আসন হারাতে হয়েছে। সংখ্যা গরিষ্ঠতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু বিজেপির দাপট অনেকটাই বেড়ে গেছে। দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী নিতে হয়েছে বিজেপি থেকেই।
প্রশান্ত কিশোর বারবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ একবার এসে বলে দিন, আমরা জিতলে নীতীশ কুমারই আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন। একবার, দু’বার নয়, বারবার এই চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন। কিন্তু মোদি বা অমিত শাহ এখনও সেই ঘোষণা করেননি। বোঝাই যাচ্ছে, জিতলেও নীতীশ কুমারই মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। অর্থাৎ, বিজেপি এখনও নীতীশ কুমারকে চাপে রাখার খেলাই খেলে চলেছে। আবার এটাও ঘটনা, বিজেপি একা লড়তেও পারবে না। একজন সঙ্গী দরকার। আবার নীতীশ কুমারও একা লড়ার জায়গায় নেই। ফলে, এই জোট দুই শিবিরের কাছেই একটা বাধ্যবাধকতা। জেতার পর নীতীশ কুমারকে হয়তো অন্য কোথাও পুনর্বাসন দেওয়া হবে। উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড় পদত্যাগ করায় সেখানে পুনর্বাসন দেওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেখানেও নির্বাচন হয়ে গেছে। এই বয়সে কেন্দ্রে মন্ত্রী করে দিল্লিতে আনা যাবে না। হয়তো কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল।
মোদ্দা, কথা বিজেপি, জেডিইউ, এলজেপি জোট আদৌ ক্ষমতায় আসবে কিনা সংশয়। আর এলেও নীতীশ কুমারই ফের মুখ্যমন্ত্রী হবেন, এমনটা বলা যাচ্ছে না। বলা হলেও হয়তো অল্প কয়েকদিনের জন্য। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অন্য সমীকরণ হাজির হয়ে যাবে। তাই গত বছর নবীনবাবু প্রাক্তন হয়েছেন। এবার নীতীশ কুমার প্রাক্তন হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
