‌ওই যে, বু্দ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন

স্বরূপ গোস্বামী

এক দশকের বেশি সময় ধরে সিবিআই সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত চালাচ্ছে। শুরুর দিকে নাম কে ওয়াস্তে কয়েকজন চুনোপুঁটিকে ধরপাকড়। তারপরই বহু বছর ধরে তারা শীতঘুমে।
কেন?‌ ওই যে বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন, সেই জন্য।

প্রায় চার বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সিবিআই আর ইডি তদন্ত করছে। কোর্টের ধাঁতানি খেয়ে শিক্ষামন্ত্রী গ্রেপ্তার হলেন। কয়েকজন অফিসার গ্রেপ্তার হলেন। ব্যাস, প্রায় সেখানেই থেমে গেল। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, বছর যায়। তদন্ত আর ফুরোয়া না। কোর্ট বারবার তিরষ্কার করে। তবুও টনক নড়ে না। সিঙ্গল বেঞ্চ থেকে ডিভিশন বেঞ্চ। সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্ট। তারিখ পে তারিখ। সিবিআই–‌ইডি ঘুমিয়েই থাকে। ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে গেল। যোগ্য আর অযোগ্য আলাদা করাই গেল না। যাঁরা টাকা দিলেন, শুধু তাঁরাই দাগি। যাঁরা নিলেন?‌ বহাল তবিয়তে। মাথা তো দূরের কথা, হাঁটু পর্যন্তও পৌঁছতে পারে না।
কেন?‌ কেন আবার?‌ ওই যে, বু্দ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন।

রাজ্যের নানা প্রান্তে অবাধে কয়লা তোলা হচ্ছে। এখান–‌সেখানে পাচার হচ্ছে। কারা যুক্ত, সবাই জানে। জানে না শুধু সিআইএসএফ। জানে না শুধু সিবিআই। তাই কিছু চুনোপুঁটিকে ডাকা হয়। বাকিরা কেউ দেশ ছেড়ে পালায়। কেউ দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।
কেন?‌ কেন আবার?‌ ওই যে বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন।

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে গরু পাচারের কথা রাজ্যের প্রায় সবাই জানেন। কোন পথ দিয়ে আসে। কোন রুটে পাচার হয়। কীভাবে পুলিশি কনভয়ে টাকা আসে। সেই টাকা কোথায় যায়। এগুলোও প্রায় সবাই জানে। জানে না শুধু সিবিআই। অথচ, তারা বছরের পর বছর তদন্ত করেই চলে। মাঝে কোনও এক হনুব্রত ধরা পড়লেন। দিব্যি জামিনও পেয়ে গেলেন। কেন?‌ কারণটা বড়ই অদ্ভুত। তিনি বাংলায় যে বয়ান দিয়েছিলেন, দু’‌বছরেও তার নাকি ইংরাজি অনুবাদ করা যায়নি। আর আসল মাথারা তো যথারীতি ধরাছোঁয়ার বাইরে।‌
ওই যে বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন। ওই যে বুদ্ধিজীবীরা তৃণমূলের দালাল হয়ে গেছেন।

কোনও এক কাকু। বীরদর্পে বলে গেলেন, আমার সাহেবকে কেউ ছুতেও পারবে না। তারপর যদিও বা সেই কাকু ধরা পড়লেন, অমনি চলে গেলেন বিখ্যাত উডবার্ন ওয়ার্ডে। তাঁর কণ্ঠস্বরের নমুনা কিছুতেই আর পাওয়া যায় না। ইডি–‌র লোকেরা নাকি দারুণ তৎপর। কিন্তু হাসপাতালের সুপার তাঁদের পাত্তাই দেন না। মাসের পর মাস ঝুলিয়ে রাখেন।
আচ্ছা, হাসপাতালের সুপার ইডি–‌কে এভাবে মাসের পর মাস লেজে খেলালেন কী করে?‌ এত সাহস হয় কী করে?‌
ওই যে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন।

আবশেষে কোর্ট আবার ধাঁতানি দিল। আজকের মধ্যেই ভয়েস স্যাম্পল টেস্ট নিতে হবে। বেচারা ইডির সামনে আর উপায় রইল না। রাতের মধ্যে স্যাম্পল নিতেই হল। এবার সেটা পাঠানো হবে হায়দরাবাদের কোনও এক ফরেন্সিক ল্যাবে। ওই রিপোর্ট এসে গেলেই নাকি কেল্লাফতে। বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রিপোর্ট নাকি হায়দরবাদ থেকে এসে পৌঁছোয়নি। যদিওবা পৌঁছেছে, কী আছে, জানাই গেল না। রিপোর্ট ধামাচাপা পড়ে গেল কেন?‌ সেই কাকু জামিন পেয়ে গেলেন কেন?‌
ওই যে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন।

কোনও এক প্রভাবশালীকে মাঝে মাঝে ডাকা হয়। দীর্ঘ আট–‌নয় ঘণ্টা পর বীরদর্পে তিনি বেরিয়ে আসেন। নেতাজির মতো করে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। কখনও বলেন, সিবিআই–‌ইডি আমার কাঁচকলা করবে। কখনও বলেন, শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করা হল। কখনও বলেন, আমার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ বের করে দেখাক।
আচ্ছা, সিবিআই–‌ইডি কে এমন হুমকি দেওয়ার সাহস তিনি পান কোথা থেকে?‌
ওই যে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন।

এই তো গতবছর ভোটে। একজন ড্যাং ড্যাং করে সাত লাখ ভোটে জিতে গেলেন। ভোটে যা হওয়ার,তা তো হয়েছেই। গণনাকেন্দ্র থেকেও বিরোধীদের মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হল। বিজেপির প্রার্থী ও এজেন্টরা সকাল আটটায় বাইরে ধর্নায় বসে গেলেন। বুথের তো ছেড়ে দিন, গণনাকেন্দ্রের সিসিটিভিও ভ্যানিশ। নির্বাচন কমিশন না কী একটা যেন ছিল!‌ কেন্দ্রীয় বাহিনী না কী একটা যেন ছিল!‌ সব বুথে না হয় বাহিনী থাকা সম্ভব নয়। গণনা কেন্দ্রেও বাহিনীর কোনও ভূমিকা থাকবে না?‌
এই নির্লজ্জ সন্ত্রাস আটকানোর দায়িত্ব যেন কার?‌ কার আবার?‌ বুদ্ধিজীবীদের।

শেখ শাজাহান কোথায়?‌ তিনি এবং তাঁর দুই লেফটেনেন্ট কর্নেল শিবু আর উত্তম। কী কী অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন, এতদিনে সবাই জানেন। ইডির লোকজন সন্দেশখালি গেলে শাজাহান বাহিনী দারুণভাবে আপ্যায়ন করল। তারপর থেকেই সেই মহানায়ক বেপাত্তা। বীরদর্পে ধরা দিলেন। শোনা যায়, জেলেও দিব্যি সাম্রাজ্য চলছে। আচ্ছা, সন্দেশখালির তদন্ত তো সিবিআই করছিল। সবকিছু ধামাচাপা পড়ে গেল কেন?‌ ‌
কেন আবার, ওই যে বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন।

রাজীব কুমার। সারদা কেলেঙ্কারির প্রমাণ লোপাটের দায়ে মূল অভিযুক্ত। তাঁকে নাকি সিবিআই হন্যে হয়ে খুঁজছিল। কয়েকদিন কতই না চাপানোতর। তাঁকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থেকে সেই রাজীব বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। উল্টে সিবিআই বেপাত্তা হয়ে গেল। সেই রাজীব কুমার রাজ্য পুলিশের ডিজি পর্যন্ত হয়ে গেলেন। আচ্ছা, এই আইপিএস রা তো কেন্দ্রের ক্যাডার। কেন্দ্র তাঁদের কাছে নানা কৈফিয়ত চাইতেই পারে। ট্রান্সফারও করতে পারে। তাহলে তিনি এমন বহাল তবিয়তে আছেন কীভাবে?‌
ওই যে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন। তাই তো কেন্দ্র কিছু করতে পারছে না।

গত বছরের তিলোত্তমা। রাজ্য উত্তাল হয়ে উঠল। কত কেলেঙ্কারি সামনে এল। তারপর?‌ যেই সিবিআই–‌এর হাতে গেল, পর্বতের মূষিক প্রসব। রাজ্যের পুলিশ যে তত্ত্ব সাজিয়েছিল, সিবিআই এর রিপোর্ট যেন তারই জেরক্স কপি। বেচারা সঞ্জয় ছাড়া আর কাউকে নাকি পাওয়াই গেল না। বলা হয়, প্রমাণ লোপাট হয়েছে। লোপাট করল কারা?‌ তারা এত সাহস পেল কোথায়?‌ প্রমাণ লোপাট হয়েছে বললেই দায় খালাস?‌ তদন্তকারীদের আর কোনও দায় নেই?‌
ওই যে, বুদ্ধিজীবীরা কিছুই বলছে না। তাই সিবিআই কিছু করতে পারল না।

এবার সর্বোচ্চ আদালত। আরজি কর কাণ্ডে সুয়োমোটো মামলা টেনে নিল। তারপর যথারীতি তারিখ পে তারিখ। অনন্তকাল ঝুলিয়ে যাওয়া। যেন স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। যেন সব রাগ, সব প্রতিবাদ সময়ের নিয়মে খেই হারিয়ে যায়। হলও তাই। সেই বিচারপতির কী প্রাইজ পোস্টিং হয়, এখন সেটাই দেখার। প্রাইজ পোস্টিং দেওয়ার মালিক কে?‌ কে আবার?‌ ওই বুদ্ধিজীবীরা।

সিবিআই–‌ইডি তো আর রাজ্যের বাহিনী নয়। তখনও তারা পাঁচিল টপকে চিদাম্বরমের বাড়িতে ঢোকে। কখনও কুড়ি বছর আগের মামুলি এক মামলায় ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীকে ধরে। আমাদের রাজ্যের বেলায় তারা এমন ধ্যাড়ায় কেন?‌ এমন অপদার্থতার নজির রেখে যায় কেন?‌ একটা সিভিক ভলান্টিয়ারও যেটা পারে, সর্বশক্তিমান সিবিআই–‌ইডি সেটুকুও পারে না কেন?‌
কেন ‌আবার?‌ ওই যে, বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে আছেন। আসলে, সিবিআই–‌ইডি তো প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে চলে না। চলে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের কথায়।

চাইলে এমন উদাহরণ আরও অনেক তুলে ধরাই যায়। যেখানেই কেন্দ্রের কিছু করণীয় থাকে, সেখানেই প্রশ্ন উঠে যায়, বুদ্ধিজীবীরা কোথায়?‌ কোথায় গেলেন অপর্ণা সেন, কৌশিক সেনরা?‌ আর আমরাও মেতে যাই সেই প্রচারে। আগে বামেরা বুদ্ধিজীবীদের নামে দু’‌চারটে গালমন্দ পেড়ে বিস্তর আনন্দ পেতেন। এখন সেই প্রচার হাইজ্যাক হয়ে গেছে। এখন বিজেপি, আইটি সেল সেই প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। বামেরাও নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘‌দেখেছো, আমরা যেটা বলতাম, এখন বিজেপিও সেটা বলতে শুরু করেছে!‌’‌ তারপর পা–‌চাটা, চটি চাটা, দালাল — এসব বলে হয় রাগ ঠান্ডা করছেন। নইলে, তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন।

যেখানে যেখানে বিজেপি–‌র বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠতে পারত, যেখানে যেখানে কেন্দ্রের অপদার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারত, সুকৌশলে সেগুলো ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের দিকে। আর বামেরাও দিব্যি তালে তাল দিয়ে যাচ্ছেন। ভাবছেন, ফেসবুকে বুদ্ধিজীবীদের গাল পেড়ে, বা গালাগাল দেওয়া পোস্টে লাইক দিয়ে বিপ্লব আনবেন।

কোন ফাঁদে পা দিচ্ছেন, বোঝার বুদ্ধিটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। ধন্যি জুকেরবার্গ। কী অদ্ভুত একটা জিনিস বানিয়েছেন। শুধু একটা ফেসবুক, মানুষের চিন্তা–‌চেতনাকে কতখানি নির্বোধ বানিয়ে দিতে পারে।

কমরেড, ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র‌্যাকটিস করুন।।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *