রক্তিম মিত্র
এই বাংলা ভারতকে জাতীয় সঙ্গীত দিয়েছে। এই বাংলা দেশকে বন্দেমাতরম দিয়েছে। এই বাংলার হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধে আত্ম বলিদান দিয়েছে। অথচ, সেই বাংলা ভাষার প্রতি অদ্ভুত এক সন্দেহের আবহ। সচেতনভাবে এই আবহ তৈরি করা হচ্ছে।
মাতৃভাষা বাংলা হলেই নাকি বাংলাদেশি। অতএব, তাঁকে ধরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দাও। এটাই যেন জাতীয় নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাঁরা একটু লেখাপড়া শিখে উচ্চ পদে আসীন, তাঁদের ওপর হয়তো এখনই আঁচ পড়ছে না। কিন্তু যাঁরা ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ একটি বা দুটি রাজ্য নয়, বিভিন্ন রাজ্য থেকে এই নির্যাতন ও বিতাড়নের খবর আসছে।
ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশভাগের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে দুটি রাজ্যকে। বাংলা ও পাঞ্জাব। পাঞ্জাবের একটি অংশ চলে যায় পাকিস্তানের দিকে, আর বাংলার একটি অংশও চলে যায় পাকিস্তানের সঙ্গে। পরে সেই পূর্ববঙ্গ স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ঘটনাচক্রে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাংলা ও পাঞ্জাবের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আন্দামান সেলুলার জেলে গেলে যে শহিদদের নাম চোখে পড়বে, তাঁদের মধ্যে সবথেকে বেশি খোদাই রয়েছে বাঙালির নাম।
অথচ, সেই বাংলাকে ও বাঙালিকে হেয় করার একটা প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখালেও সেই সন্দেহ যাচ্ছে না। এইভাবে অনেককেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। অথচ, তাঁরা বংশ পরম্পরায় এই বাংলার নাগরিক। তাঁদের পরিবারের লোকেরা এখনও মালদা বা কোচবিহারেই থাকেন। অনেকসময় দুই দেশে ফ্ল্যাগমিটিংয়ের পর ফিরিয়েও নেওয়া হচ্ছে। তাহলে যাঁরা কোনওকিছু খতিয়ে না দেখেই পাঠিয়ে দিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হল? রাষ্ট্র কি একবারও তারআ এই হঠকারিতার জন্য ক্ষমা চাইল?
বছরের পর বছর ধরে এই রাজ্যে অন্যান্য প্রদেশের মানুষ বাস করেন। মধ্য কলকাতায় হাঁটলে বোঝাই যাবে না, আপনি কলকাতায় আছেন। আসানসোল, খড়্গপুরের মতো রেল শহরে বাংলা ভাষা শোনাই যায় না। উত্তর ২৪ পরগনা ও হুগলির শিল্পাঞ্চলেও ভিন রাজ্যের শ্রমিকের সংখ্যা বাঙালি শ্রমিকদের থেকেও বেশি। শিলিগুড়ি শহরেও বাঙালির থেকে অবাঙালির সংখ্যা বেশি। কই, কেউ তো তাঁদের চলে যেতে বলে না। তাঁরা বেশ সম্মানের সঙ্গেই আছেন। তাহলে বাঙালিদের প্রতি এই অবহেলা ও অপমান কেন? হ্যাঁ, অনুপ্রেবশ হয়েছে, হচ্ছে, এটা ঘটনা। কিন্তু সেটা আটকানোর প্রাথমিক দায়িত্ব কার? বিএসএফ কাদের অধীনে? গত দশ বছরে অনুপ্রবেশ কি কমেছে? নাকি বেড়েছে? যদি বেড়ে থাকে, তাহলে তো কেন্দ্রের লজ্জিত হওয়া উচিত। তাঁরাই কিনা বেশি সুর চড়াচ্ছেন। এটাও যেন তাঁদের সাফল্য।
কোনটা গর্বের, আর কোনটা লজ্জার, এই বোধটাই নেই। না বোঝে ইতিহাস, না বোঝে দেশপ্রেম। আকাট মূর্খদের হাতে দেশ চালানোর ভার থাকলে এমনটাই হয়। এঁরা যাঁকে তাঁকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেন। এবার এই অর্বাচীনদেরও সোচ্চারে ‘আকাট মূর্খ’ বলার সময় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মূর্খ বলা হয়তো শোভনীয় নয়। কিন্তু কী আর করা যাবে, মূর্খ লোকেরা যদি এই চেয়ারে বসেন, মূর্খই বলতে হবে।
