বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয়.‌.‌.‌

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের অফিসের ছাদ থেকে ধর্মতলায় ২১ জুলাইয়ের জনজোয়ার দেখা যায় স্পষ্ট। সভা যখন শেষের দিকে, খবরটা পেলাম। আজিজুল হক প্রয়াত।

সামনে থেকে দেখেছি বোধহয় দু–‌তিনবার। বইমেলায় আসতেন। চেয়ারে বসে থাকতেন। ঘিরে থাকা জটলায় অধিকাংশই তরুণ প্রজন্ম। হেসে বলতেন, ‘তরুণ প্রজন্মের সত্যিই হাতে কোনও কাজ নেই দেখছি! নইলে এই বুড়ো মরে যাওয়া লোকটার কথা শুনতে বসে আছ এতক্ষণ!’

আর একবার। এক সভায় বক্তব্য শুনতে গিয়েছিলাম। লাঠি হাতে এলেন। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে কথা বললেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন সবাই। সেখানেও প্রায় সবাই তরুণ প্রজন্মের।

একজন মানুষকে জানতে হলে তাঁকে সামনে থেকে দেখতে হবে, রোজ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে, এই ফর্মুলায় বিশ্বাসই করি না আমি। তার পরেও আজিজুল হক যেন ধাক্কা দিয়ে যান কোথাও।
তাঁর লেখা বইগুলো পড়েছি প্রায় সব কটাই। এখনও পড়ি, মাঝে মাঝে।

একজন মানুষ, শিক্ষিত মানুষ। জীবনে কত কিছুই না করতে পারতেন। হয়ে গেলেন ‘আগুনখেকো নকশাল!’ নাকি ভুল বললাম। তিনি বোধহয় নকশাল হওয়ার জন্যই জন্মেছিলেন। মাস্টারি, ডাক্তারি, বা খেলোয়াড়, যে পেশাই হোক না কেন, প্রতিবাদের ঝড়ে সেখানেও হয়ে উঠতেন আগমার্কা!

‘কারাগারে আঠারো বছর’—লেখা নয়, যেন রূপকথা। আজিজুল তখন যুবক। দমদম জেল ভেঙে পালালেন দলবল নিয়ে। ধরা পড়লেন। বেধড়ক মার। মার খেতে কি ভালোবাসতেন আজিজুল?

রুনু গুহনিয়োগী নেতৃত্বে পুলিশ তো বেধড়ক মারতই। মাঝরাতে জেলে ঢুকত কংগ্রেসের পোষা গুণ্ডারা। লোহার রড, লাঠি, সাইকেলের চেন, কাঁটা লাগানো ডান্ডা। মদ খেয়ে চুর। নকশাল পিটিয়ে নেশা উতরানো। সঙ্গে কম্বল ধোলাই। দুটো–‌তিনটে কম্বলে মুড়িয়ে দমাদ্দম লাঠিচার্জ। গায়ে কোনও দাগই পড়বে না। ভিতরে হাড় ভেঙে চুরচুর। আদালতে পুলিশি অত্যাচারের প্রমাণ উধাও।

জেলে তখন নতুন এক অফিসার। সেই অফিসার শুরুতে কিছুদিন নকশাল হওয়ার নেশায় ঝুঁকেছিলেন। পরে একেবারে উল্টো পথে হেঁটে পুলিশ হয়ে গেলেন! আজিজুলের সঙ্গে পরিচয় ছিল। জেলে গল্প করতেন, ‘কেন এ সব করছেন আজিজুলদা? একটু তো মেনে নিতে পারেন। পুলিশের মার খাচ্ছেন এত।’ হেসে আজিজুলের উত্তর ছিল, ‘মেনে নিলে তো আমি পুলিশ হয়ে যেতাম! আর আমরা পুলিশকে মারছি, ওরা মারবে না! আমরা দুটো মারলে ওরা দশটা মারবে। এটাই তো বিপ্লবের নিয়ম।’

সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় জমানার পুলিশ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনিও জেলে আসতেন। গল্প করতেন। বোঝাতেন, ‘আপনার মতো একজন মানুষ জেলে পচছেন কেন?’ আজিজুল পাল্টা বলতেন, ‘জেলের খাওয়া ঠিক করো। কাগজ পড়তে দাও। কাগজ–‌কলম দাও। লিখব। বই দাও। পড়ব। না হলে কিন্তু জেলেই আন্দোলন শুরু করে দেব।’

সাতাত্তরে বামফ্রন্ট সরকার আসার পরে ছাড়া পেয়েছিলেন। ৮২-তে সেই সরকারের পুলিশের হাতেই আবার গ্রেপ্তার। অত্যাচারে শরীর তখন শেষ। বলতেন, ‘আমার শরীরের কোনও হাড়ই আর আস্ত নেই!’

তবু কী উজ্জ্বল দুটো চোখ। রোগা–‌ক্ষয়ে যাওয়া শরীরে চোখ দুটো জ্বলত তারার মতো। আসলে, সেই চোখ যে তখনও দেখত স্বপ্ন। আবার হবে বিপ্লব। আবার হবে বিদ্রোহ। বলতেন, ‘এই ইয়ং ছেলে–‌মেয়েগুলোকে যদি আবার একবার বিপ্লবের আগুনে ফেলে দিতে পারতাম।’

তিনি পারেননি। নকশাল আন্দোলনও ঠিক ছিল না ভুল, বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস হতে পারে কি পারে না, সেই বিশ্লেষণেরও আমরা কেউ নই। কিন্তু ওঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন দিন বদলের। সেই স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো হারিয়ে গিয়েছেন অনেকেই। অনেকেই আবার রং বদলে হয়ে গিয়েছেন বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি—আরও কত কী। আজিজুল হক কিন্তু তাঁর ফেলে আসা পথেই হাঁটতে চেয়েছিলেন চিরকাল।

মার খেয়েছেন। উঠে দাঁড়িয়েছেন। নকশাল আমলের সেই বিপুল চক্রবর্তীর কবিতার মতো—

পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাবুকের দাগ যেন থাকে

এমন ভাবে মারো

দাগ যেন বসে থাকে বেশ কিছুদিন

এমন ভাবে মারো

এমন ভাবে মারো

তোমার মারের পালা শেষ হলে

আমাকে যেন দেখায় ডোরাকাটা বাঘের মতন!

ভাল থাকবেন আজিজুল হক।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *