প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু ওঠে না

রক্তিম মিত্র

কোনও পর্যটক যদি কলকাতায় আসেন, তিনি কোথায় যাবেন?‌ নিশ্চয় ধাপার মাঠে যাবেন না। তিনি যেতে পারেন ভিক্টোরিয়ায়, জাদুঘরে, সায়েন্স সিটিতে, ইকো পার্কে। কোনও পর্যটক দার্জিলিংয়ে গেলে কোথায় যাবেন?‌ নিশ্চিতভাবেই দার্জিলিং ম্যালে।

ধরা যাক, সেখানে একদল জঙ্গি এসে হামলা চালাল। হতেই পারে, পুলিশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিতে হামলা হয়েছে। সেই জঙ্গিরা দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন, পুলিশ কিছুই করতে পারল না। এই পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়।

কিন্তু সেই মৃতদেহগুলো দু’‌ঘণ্টা পড়ে রইল। কেউ উদ্ধারে এগিয়ে এল না। এমনটা নিশ্চয় ভাবা যায় না। কিন্তু প্যাহেলগাওয়ে তো এমনটাই ঘটেছে। কেন ইন্টিলিজেন্স বুঝতে পারল না, এই প্রশ্ন না হয় মুলতুবি রইল। কেন সেনাবাহিনী আটকাতে পারল না, এই প্রশ্নও না হয় তোলা রইল। কেন জঙ্গিরা পালিয়ে গেল, সে প্রশ্নও থাক। কিন্তু দু’‌ঘণ্টা পরেও কেন সেনাবাহিনীর দেখা নেই, কেন প্রশাসনের দেখা নেই, এই প্রশ্নও উঠবে না?‌

কাশ্মীরের কোনও প্রত্যন্ত এলাকায় হলে না হয় বলা যেত খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু যে জায়গায় এই ঘটনা ঘটেছে, সেটা তো একটি বহুল পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র। এই জায়গায় কত ছবির শুটিং হয়েছে। ফেসবুক ঘাটুন। প্যাহেলগাঁও থেকে ঘুরে আসা অধিকাংশ পর্যটকের টাইম লাইনে এখনও এই জায়গার ছবি। এমন একটা জায়গায় ন্যূনতম নিরাপত্তা থাকবে না?‌ এমন একটা জায়গায় গুলি চলার এতক্ষণ পরেও দেহ উদ্ধার হবে না?‌

এই প্রশ্নগুলো তুলতে গেলেই আপনি দেশদ্রোহীর তকমা পাবেন। মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল, জঙ্গিরা নাকি বেছে বেছে হিন্দুদের মেরেছে। অর্থাৎ, দ্রুত একটা হিন্দু–‌মুসলিম ন্যারেটিভ তৈরি হয়ে গেল। ব্যাস, টিভি চ্যানেলগুলো এরকম একটা হাতেগরম ইস্যু পেলে আর কী চাই!‌ ভাসিয়ে দাও পাকিস্তানের নাম। দাগিয়ে দাও সংখ্যালঘুদের। আর মাঝে মাঝে গাল পাড়ো সেকু–‌মাকুদের। এটাই রাষ্ট্র। এটাই তার লেজুড় মিডিয়া। এটাই তার আইটি সেল।

ভারত কীভাবে বদলা নেবে?‌ ভারতের হাতে কী কী অস্ত্র আছে?‌ কটা মিগ বিমান আছে?‌ কটা যুদ্ধজাহাজ আছে?‌ পাকিস্তানের কটা আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কয়েকমাস আগে বাংলাদেশে অশান্তির সময়েও এমন কভারেজই দেখেছিলাম। বাংলাদেশের থেকে আমাদের সামরিক শক্তি বেশি, এটা প্রমাণ করতে মরিয়া ছিল কোনও কোনও চ্যানেল। আচ্ছা, বাংলাদেশের থেকে আমাদের শক্তি বেশি, এটা এত ঘণ্টা ধরে বোঝাতে হবে?‌ যে যুদ্ধ কখনই হবে না, তা নিয়ে ঘণ্টার ঘণ্টা এমন বিদ্বেষমূলক আলোচনা!‌ হাসিও পায়, আবার রাগও হয়।

তড়িঘড়ি ভারত সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করে দিল। ওমনি হুঙ্কার, এবার পাকিস্তান আর জল পাবে না। শুকিয়ে মরবে। কী উল্লাস!‌ আচ্ছা, পাকিস্তান যদি জল না পায়, তাতে সেই জঙ্গিদের বা আইএসআই–‌এর কী আসে যায়!‌ বরং সে দেশে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব আরও প্রকট হবে। ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানরা কি সেটাই চান? আচ্ছা, ধরেই নিলাম, সিন্ধুর জল আর পাকিস্তানে যাবে না। তাহলে সেই জল কোথায় থাকবে?‌ এত জল ধরে রাখার মতো বাঁধ আমাদের আছে তো?‌ সেই পরিমাণ জল রাখতে যত বাঁধ লাগবে তা নির্মাণ করতে কত বছর লাগবে?‌ কত খরচ হবে?‌ কোনও ধারণা আছে?‌ ‌কোন গন্ডমূর্খের দল দেশ চালাচ্ছে? মূর্খের হাতে শাসন ক্ষমতা দিলে এমনটাই হয়। তারা এমন মিডিয়াকেই লালন করে।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের মগজে কতখানি কারফিউ জমে আছে। কী সহজে সেই মগজ ধোলাই করা যায়। কী সহজে দিনভর চ্যানেলগুলি চিৎকার করে যায়। কী সহজে সরকারের ব্যর্থতাকে আড়াল করে তীরটা অন্যদের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। কী সহজে যুদ্ধ যুদ্ধ একটা আবহ তোলা যায়। আর আমরাও তেমনি। সারাদিন এই আলোচনায় মেতে থাকি। এই চরম ব্যর্থতাও যেন সরকারের চরম সাফল্য, এরকম একটা প্রচারে সামিল হয়ে যাই। এমন ভান করি, যেন সেকুলার হওয়াটা বিরাট অপরাধ। যেন সম্প্রীতি নয়, হিংসা আর বিদ্বেষই মূলস্রোত।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.