ধীমান সাহা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা খুব চিন্তায়। শুভেন্দু অধিকারী এত হিন্দু হিন্দু করছেন কেন? কথায় কথায় হিন্দু–মুসলিম তাস খেলছেন কেন? যেখানে যাই ঘটুক, তার পেছনে এমন উস্কানিমূলক মন্তব্য করছেন কেন?
বছর দুই তিন আগেও তো তিনি এমন সুরে কথা বলতেন না। বিজেপি করতে গেলে যেটুকু বলতে হয়, সেটুকুই বলতেন। তখনও হুঙ্কার দিতেন। কিন্তু তাতে এত ‘হিন্দু–মুসলমান’ থাকত না। মনে করে দেখুন, বছর দুই আগের কথা। তিনি হুঙ্কার ঝাড়লেন, পুজোর আগেই কিছু একটা হতে চলেছে। কিছুই হল না। এবার এলেন ডিসেম্বর ধামাকায়। ডিসেম্বরের মধ্যেই নাকি বড় সড় একটা ধামাকা হতে চলেছে। আসলে, দিল্লির নেতাদের আশ্বাসে তাঁর মনে হয়েছিল, দিল্লি বুঝি নড়েচড়ে বসেছে। কিন্তু তাঁরা যে নিজেদের রাজনৈতিক অঙ্কটুকুই বোঝেন, তাঁরা যে শুধু নিজেদের ক্ষমতায় থাকাটুকুই নিশ্চিত করতে চান, এই সহজ সত্যিটা শুভেন্দু সত্যিই বোঝেননি। বুঝলেন, অনেক দেরিতে। যখন ডিসেম্বরটা জানুয়ারি হয়ে গেল। জানুয়ারিটা ফেব্রুয়ারি হয়ে গেল। আস্তে আস্তে সেপ্টেম্বর হাজির হয়ে গেল। সেই পুজো থেকে অন্য পুজো হাজির হয়ে গেল।
দিলীপ ঘোষ অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন, সিবিআই বা ইডি আসল কাজের কাজ কিছুই করবে না। তিনি অনেক আগে থেকেই বুঝে গিয়েছিলেন, এই দুই তদন্তকারী সংস্থার হাত–পা বেঁধে রাখা হয়েছে। কারা বেঁধে রেখেছেন, কেন বেঁধে রেখেছেন, তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তিনি বুঝেছিলেন, দিল্লির নেতৃত্ব এই রাজ্য থেকে কখনই তৃণমূলকে সরাতে চায় না। তৃণমূলকে রেখে দিতে পারলেই তাঁদের লাভ। তাই, তৃণমূলকে অক্সিজেন দিয়ে টিকিয়ে রাখতে যা যা করার দরকার, মোদি–অমিত শাহরা তাই তাই করবেন। দিলীপ ঘোষ শুরুতে দলের মধ্যে উষ্মা প্রকাশ করতেন। পরের দিকে বাইরেও বলে ফেলেছেন। সেই কারণেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেই কারণেই বারবার তাঁর মুখ বন্ধ করতে নানা ফতোয়া এসেছে। এমনকী ভোটের মুখে হঠাৎ করে তাঁর কেন্দ্র বদল কেন, সেটাও এতদিনে পরিষ্কার। স্বয়ং দিলীপ ঘোষও প্রকাশ্যে বারবার বলেই ফেলেছেন।
অর্থাৎ, দিলীপ ঘোষ যেটা অনেক আগে বুঝেছেন, শুভেন্দু এতদিনে বুঝছেন। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি দিল্লিতে গিয়ে নালিশ ঠুকবেন, আর অমিত শাহ সিবিআই–কে লেলিয়ে দেবেন। কিন্তু তা যে হওয়ার নয়, এটা বুঝতে অনেক সময় লেগে গেল। দিল্লির নেতাদের কাছে রাজ্য বিজেপির চেয়ে তৃণমূল অনেক বেশি প্রিয়, এটা বেশ বুঝেছেন। সিবিআই, ইডির ওপর ভরসা করতে গেলে বারবার ডুবতে হবে, হাঁসির খোরাক হতে হবে, অভিজ্ঞতা তাঁকে এটুকু অন্তত শিখিয়েছে। তাই ভুলেও আর সিবিআই, ইডির ভরসায় কোনও হুঙ্কার ছাড়েন না। এখন একটাই তাস, হিন্দুত্ব। অন্তত এই প্রচারটা মানুষ কিছুটা হলেও নিচ্ছে, এটুকু বুঝেছেন।
শুভেন্দুর জায়গায় অন্য কেউ হলে ঝাঁকের কই এতদিনে দিব্যি ঝাঁকে মিশে যেত। তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন বলে বিজেপিতে এসেছিলেন। এসে বুঝলেন, দিল্লির নেতারা তৃণমূলকে অক্সিজেন দিতেই বেশি ব্যস্ত। কেন্দ্রীয় এজেন্সি প্রমাণ জোগাড় করার থেকে প্রমাণ লোপাট করায় বেশি ব্যস্ত। এখন কী করবেন? অন্যরা আবার পুরনো দলে ফিরে গেলেও তাঁর সে উপায় নেই। তিনি জননেতা, মুখ্যমন্ত্রীকে হারিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিজেপিতে গেছেন। তাই তাঁর হতাশ হওয়ার উপায় নেই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পাশে নেই বুঝেও তাঁকে হুঙ্কার দিয়ে যেতেই হবে।
কিন্তু সেই হুঙ্কার কীসের ভরসায়? এটুকু বুঝেছেন, সিবিআই বা ইডির ভরসায় কোনও হুঙ্কার চলবে না। কাজেই ‘হিন্দুত্ব’ ছাড়া আর উপায় কী? এই হিন্দুত্বের আস্ফালনে কতখানি সাম্প্রদায়িক ইন্ধন আছে জানা নেই। যা আছে, তা হল সিবিআই, ইডির প্রতি তীব্র অনাস্থা।