সৃজন শীল
বেশি টাকা থাকলে কী হয়? বহুকাল আগে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল। নিজেই তার উত্তরও দিয়েছিলেন, ‘ছবির পোস্টারে সত্যজিৎ রায়ের ওপর আর ডি বনশলের নাম থাকে।’ অর্থাৎ, প্রোডিউসারের নাম পরিচালকের আগে।
আইসিসি–র দিকে তাকালে সেই প্রবাদটাই বারবার মনে পড়ে যায়। এখানে ভারতীয় বোর্ড সবচেয়ে বিত্তশালী বোর্ড। অতএব, তারা যা বলবে, তাই হবে। তারা যা যা অন্যায় আবদার জুড়বে, সেটাকেই মান্যতা দিতে হবে। এমনকী ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে অযোগ্য লোকটি যদি আইসিসি সভাপতি হতে চান, তাও মেনে নিতে হবে।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে নতুন এক তামাশা চলছে। পাকিস্তান আয়োজক। অতএব, সব দেশ খেলতে গেলেও ভারতীয় দল খেলতে যাবে না। প্রথমে বহুদিন ঝুলিয়ে রাখা হল। বলা হল, কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়পত্র না দিলে যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ, সেই ছাড়পত্র আদায়ের কোনও চেষ্টাও নেই। বলা হল, আমরা অন্য দেশে খেলব। ভারতের আবদার মেনেই খেলা দেওয়া হল দুবাইয়ে। এখানেই শেষ নয়। যে কোনও টুর্নামেন্টের আগে অধিনায়কদের নিয়ে ফটোসেশন হয়। রোহিত শর্মা সেখানে যাবেন না। অতএব, সেই অনুষ্ঠানটাই বাতিল। এমনকী, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উদ্বোধনও প্রায় হল না বললেই চলে।
প্যানেলের যিনি ভারতীয় আম্পায়ার ছিলেন, তিনিও জানালেন পাকিস্তানে যাবেন না। সেটা আবার বড়াই করে ঘোষণা করল ভারতীয় বোর্ড। যে প্রাক্তন ক্রিকেটাররা ধারাভাষ্য দিচ্ছেন, তাঁদেরও প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হল, তাঁরা পাকিস্তানে যাবেন না। যে ঘৃণার বিস্তার ঘটছে, তার উৎস কোথায়?
একসময় বলা হত, কাশ্মীর সমস্যা কোনও সমস্যাই নয়। গাভাসকার আর ইমরান খানকে বসিয়ে দাও। ওরা দুজন ঠিক মিটিয়ে দেবেন। এই ভারতের কত রমনী যে ওয়াসিম আক্রামকে মনে মনে প্রেম নিবেদন করেছিলেন, তার ঠিকঠাক সমীক্ষা হলে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আবার শচীন তেন্ডুলকার, বিরাট কোহলিরা ভারতে যতখানি জনপ্রিয়, সীমান্তের ওপারেও ততটাই। ভোট নিন বিরাট না বাবর? পাকিস্তানেও অধিকাংশ ভোট বিরাটের দিকেই পড়বে।
কিন্তু সেই ভারত খেলতে যায় না পাকিস্তানের মাটিতে। পাকিস্তান যে এ দেশে আসবে, তারও উপায় নেই। আমাদের দেশের আইপিএলে অচ্ছুৎ হয়ে থাকতে হয় পাক ক্রিকেটারদের। কোন ফ্র্যাঞ্চাইজির ঘাড়ে কটা মাথা তারা পাকিস্তানের খেলোয়াড়কে দলে নেবে! আইসিসির ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রামের আগামী পাঁচ বছরে ভারত–পাক দ্বিপাক্ষিক কোনও সিরিজ রাখা হয়নি।
সরকার যে অনুমতি দেবে না, এশিয়া কাপের আগে সেটা আগাম জয় শাহ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন! বাবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলে সরকারি সিদ্ধান্ত ছেলেই ঘোষণা করে ফেলেন। কোনটা প্রকাশ্যে বলতে নেই, কোনটা আগাম বলতে নেই, এই ন্যূনতম বোধটুকুও যাঁর নেই, তিনি ছিলেন দেশের বোর্ডসচিব! এখন তো তিনি আবার আইসিসি চেয়ারম্যান। ওই যে, বাবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে যা হয়!
এই দুই দেশের শেষ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হয়েছে অন্তত বারো বছর আগে। খেলার মাঝে এমন যুদ্ধ–যুদ্ধ আবহ কারা আনতে চাইছেন? ভারত–পাক রেশারেশি তো আগেও ছিল। তাই বলে গাভাসকার–কপিলদেবরা কি পাকিস্তানে যেতেন না? নাকি ইমরান–মিয়াদাদরা ভারতে আসতেন না?
সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ভারত যেবার পাকিস্তানে গেল, সেবার পাক সফরে যাওয়ার আগে তাঁরা দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে। বাজপেয়ী কী বলেছিলেন, আজও প্রবাদ হয়ে আছে। তিনি সৌরভ–শচীনদের বলেছিলেন, ‘দিল ভি জিতকে আনা।’ অর্থাৎ, হৃদয়ও জিতে এসো। একজন রাষ্ট্রনায়কের কাছে এমনটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু এখন পরিবেশটাই পাল্টে গেছে। জাতীয় চ্যানেলে সারাক্ষণ পাক বিরোধী জেহাদ। প্রতিদিন একটা করে যুদ্ধের আবহ তৈরি করো। যাই ঘটুক, এর সঙ্গে পাকিস্তানকে জুড়ে দাও। মনে মনে ঘৃণা ঢুকিয়ে দাও। রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় ছাড়া এমন প্রোপাগান্ডা চলতে পারে!
একা বিজেপিকে দায়ী করে লাভ নেই। ইউপিএ আমল থেকেই সিরিজ বন্ধ রাখার তোড়জোড়। আইপিএলে পাক ক্রিকেটারদের অচ্ছুৎ রাখার কাজটা প্রথম হয় ইউপিএ আমলেই। তাই তারাও আজকের এই পরিস্থিতির দায় অস্বীকার করতে পারে না। মুম্বইয়ে তাজ হোটেলে উগ্রপন্থী হামলার সঙ্গে ক্রিকেটকে জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা তখনও দেখা গেছে। এই আমলে দিন দিন সেটা বাড়ছে। সরকারি উদ্যোগে ঘৃণার বিপুল বিস্তার। মাঝখান থেকে খেলাটাই বন্ধ হয়ে গেল। ওই দেশে সিরিজ খেলতে যাওয়া চলবে না। ওই দেশ থেকে এই দেশে সিরিজ খেলতে আসা যাবে না। ঘৃণার রাজনীতিকে ক্রিকেটের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
বোর্ডও অসহায়। তাকে সরকারের সুরে সুর মিলিয়েই কথা বলতে হবে। এক দশকের ওপর সিরিজ বন্ধ তো রাখলেন। এতে দুই দেশের সম্পর্কের কী উন্নতিটা হল? সেই আবহমান কাল ধরে শুনে আসছি, কাশ্মীর সমস্যা। এখনও সেই কি সেই সমস্যা কমেছে? বরং অনেক বেড়েছে। ভোট এলেই একটা করে সার্জিকাল স্ট্রাইক দেখাতে হবে। বীরত্বের ফানুস ওড়াতে হবে। নিজেদের সব অক্ষমতাকে আড়াল করতে দেশপ্রেমের হাওয়া তুলতে হবে। ধর্মের সুড়সুড়ি উস্কে দিতে হবে। পাকিস্তান তো আছে। মাঝে মাঝে ভাবি, ভাগ্যিস একটা পাকিস্তান আছে। নইলে, এরা কী বলে ভোট চাইত? কী বলে হাওয়া গরম করত?
রাজনীতির ব্যাপার রাজনীতির লোকেরা বুঝুন। তার সঙ্গে খেলাকে না জুড়লেই নয়! নিজেরা সমস্যা মেটাতে পারছেন না। সেই ব্যর্থতার বোঝা খেলাধূলার ওপর কেন চাপাচ্ছেন? যে সম্প্রীতি আপনারা আনতে পারেননি, তা ক্রিকেটাররাই পারেন। ওঁদের খেলতে দিন। এই দমবন্ধ আবহে ওঁরা অন্তত তাজা অক্সিজেন আনতে পারবেন।