প্রতুলের গান যেন সম্প্রীতির দৃপ্ত স্লোগান

সরল বিশ্বাস

যেন তিনি একটিই গান লিখেছিলেন। যেন তিনি একটিই গান গেয়েছিলেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায় বললেই গড়পড়তা বাঙালি ঘুরে ফিরে ওই একটি গানের একটি দুটি লাইনই আউড়ে যায়— আমি বাংলায় গান গাই। মৃত্যুর পরেও সেই ট্রাডিশনই বজায় রইল। সবাইকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই হবে। ফেসবুকে তাঁর ছবি দিয়ে কিছু একটা লিখতেই হবে। অতএব, ঘুরেফিরে এল ওই একটাই লাইন।

স্মৃতিচারণ বা শ্রদ্ধার এখানেই শেষ নয়। কেউ কেউ বলে বসলেন তৃণমূলপন্থী। কেউ কেউ মমতা ব্যানার্জির পাশে তাঁর ছবি সাঁটিয়ে বিদ্রুপেও মেতে রইলেন। হু হু করে কমেন্ট পড়তে থাকল। এমন দিনে এমন একজন শিল্পীকে টেনে নামানোর এমন মহার্ঘ্য সুযোগ হাতছাড়া করা যায়!‌ ওই যে চটিচাটা না কী একটা বিশেষণ। ভরিয়ে দাও সেই বিশেষণে।

তখন নয়ের দশক। এপার বাংলার বঙ্গজীবনে তখনও একুশে ফেব্রুয়ারির তেমন চল ছিল না। বাঙালিয়ানা উদযাপনের দিন ছিল সেই পয়লা বৈশাখ। তখন দূরদর্শনে নববর্ষের সকালে হত প্রভাতী বৈঠক— নববর্ষের আড্ডা। থাকতেন নানা জগতের দিকপাল মানুষেরা। সেখানেই প্রথম দেখি প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে। সেখানেই প্রথম তাঁর গান শোনা। হ্যাঁ, ওই গানটাই। কিন্তু তখন তো আর ইউটিউব ছিল না। তাই ইচ্ছে থাকলেও বারবার শোনার উপায় থাকত না। চট করে গানের লিরিক্সও পাওয়া যেত না। কিন্তু কথাগুলো মনে গেঁথে গেল।

পরে একদিন কলকাতা বইমেলার মমার্ত মঞ্চে তাঁকে গান গাইতে শুনলাম। হাত পা নেড়ে অভিনব এক প্রদর্শনী। মনে হল, এই মানুষটাকে আর যাই হোক, ক্যাসেটে ধরা যায় না। ক্যাসেটে তো আরেই অভিব্যক্তি আসবে না। আস্তে আস্তে তাঁর ক্যাসেটও বেরোল। একটার পর একটা অন্য ধারার গানের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। কখনও চ্যাপলিন, কখনও জটায়ু— কত চরিত্রকে নতুন করে চিনতে শিখলাম। স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখেছি নতুন মানুষজন। কী অনবদ্য কথা। ভেতরটা যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

কবিতা থেকে একটু দূরে দূরেই থাকতাম। কী জানি, হয়তো দুর্বোধ্যতার কারণেই। মনে হত, এত গুরুগম্ভীর বিষয় অন্তত আমার জন্য নয়। কবিতা থেকে গান তো অনেক হয়েছে। কিন্তু মূলত সহজবোধ্য ও জনপ্রিয় কবিতা নিয়েই গান হত। অর্থাৎ, কবিতার জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে তাকে সুর দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু তিনি হাঁটলেন একেবারে অন্য পথে। এমন সব কবিতা বেছে নিলেন, যা গড়পড়তা বাঙালি শোনেইনি। শঙ্খ ঘোষ বা অরুণ মিত্রর কবিতা নিয়ে গান হতে পারে, কবির সুদূর কল্পনাতেও বোধ হয় এমন দৃশ্য ধরা দেয়নি। সে বাবরের প্রার্থনাই হোক, বা ‘‌আমি এত বয়সে গাছকে বলছি’‌ই হোক। এ এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ। মাঝে মাঝে ভাবি, সহজ–‌সরল, নিপাট ভাল মানুষ লোকটা এমন কঠিন চ্যালেঞ্জটা নিলেন কীভাবে?‌

সারা পৃথিবীর সঙ্গীত আত্মস্থ করেছেন। তার সঙ্গে কীর্তন, লোকসঙ্গীত মিশিয়েছেন। তারপরেও কী অবলীলায় বলতে পারেন, ‘‌কোনও প্রশিক্ষণ ছিল না। অন্য কোনও ফর্ম সম্পর্কে ধারণাও ছিল না।’‌ নিজেই তৈরি করেছেন নিজের ব্যকরণ। তাঁর পূর্বসূরিও নেই, উত্তরসূরিও হবে না। তুমুল জনপ্রিয়তা বা হলভর্তি মানুষের করতালি হয়তো তাঁর জন্য নয়। বিষয় মাস, কিন্তু মুগ্ধ হতে গেলে কোথাও একটা ক্লাস লাগে। একটা গান যখন প্রবাদসম হয়ে ওঠে, তখন তার উজ্বলতায় অন্য গান হারিয়ে যায়। এটা নির্মম এক ট্র‌্যাজেডি। সেই ট্র‌্যাজেডির মাশুলও তাঁকে দিতে হয়েছে। কত কালজয়ী গান বাঙালির কাছে পৌঁছলোই না। বাঙালি ওই একটি গানেই আটকে থাকল। ওই একটি গান দিয়েই তাঁকে চিনতে চাইল।

কিছু গান থাকে সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে অন্য পারে পৌঁছে যায়। এপার বাংলা না ওপার বাংলা, সব গুলিয়ে যায়। তাই আমি বাংলায় গান গাই এপারে যতটা জনপ্রিয়, ওপারেও ততটাই জনপ্রিয়। ওপারের মঞ্চে কী অবলীলায় গেয়ে উঠতে পারেন, ‘‌দুইজনাই বাঙালি ছিলাম/‌দেখ দেখি কাণ্ডখান/‌তুমি এখন বাংলাদেশি/‌আমারে কও ইন্ডিয়ান।’‌

যে মানুষটা নিজের একক সঙ্গীতকে গণসঙ্গীতের রূপ দিলেন, যে মানুষটা একের পর এক সংগ্রামী চেতনার গান লিখলেন, সেই মানুষটাকে কী অবলীলায় ‘‌তৃণমূল’‌ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। হতে পারে, জীবনের একটা স্তরে এসে কোথাও একটা মতের অমিল থেকেছে। কিন্তু বাকিদের মতো তিনি তো বিকৃত আক্রমণের রাস্তা বেছে নেননি। বা দন্ত বিগলিত করে শাসকের নির্লজ্জ প্রশস্তির খেলাতেও শামিল হননি। বাকিদের সঙ্গে তাঁকে এক আসনে বসিয়ে দেওয়া খুব জরুরি!‌ বিদায়বেলায় একটু সহিষ্ণুতা কি তাঁর প্রাপ্য ছিল না!‌ তাঁর গান তো তৃণমূলের জন্য লেখা নয়। তৃণমূল সেই গান শুনবেও না, কোথাও গাইবেও না। তারা ওই একটি গানের বাইরে কিছুই জানবে না, বুঝবে না। মমতার সঙ্গে তাঁর ছবি, তৃণমূল শুধু এটুকুই বুঝবে। কিন্তু বামেরাও যদি ওই আঙ্গিকেই তাঁকে চেনেন, এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের কী হতে পারে!‌

আরও একটা একুশে ফেব্রুয়ারি। অশান্ত ওপার বাংলায় নিশ্চয় বেজে উঠবে তাঁর কালজয়ী গানটা। সীমান্তের দুই পারে অনেক উস্কানির মাঝেও সম্প্রীতির মশাল হয়ে জ্বলবে ‘‌আমি বাংলায় গান গাই।’‌

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.