একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে কাদের? যতটা এপার বাংলার, ততটাই যেন ওপার বাংলার। বরং, বাংলাদেশের দাবিটা কিছুটা হলেও বেশি। মাতৃভাষার দাবিতে ওপার বাংলার যা লড়াই, মাতৃভাষার প্রতি ওপার বাংলার যে দরদ, তা আমাদের থেকে অনেকটাই বেশি। কিন্তু এবার একুশের আগে অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। আমাদের চেনা বাংলাদেশকে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। ভাষা নয়, ধর্মীয় উন্মাদনাই যেন চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেমন থাকবে এবার একুশে ফেব্রুয়ারির চেহারা? জানা নেই। আমরা বড়জোর আশা করতে পারি, বাংলা ভাষার জন্য যে গর্ববোধ অতীতে দেখা গেছে, সেই নদী একইভাবে বহমান থাকুক।
একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষার দিন নয়। যার যা মাতৃভাষা, সেই ভাষাকে আরও বেশি করে ভালবাসার দিন। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যত অনুরাগ, তা যেন নির্দিষ্ট দু–তিনটি দিনের জন্য তোলা থাকে। পয়লা বৈশাখ এলে আমরা বাঙালি হয়ে উঠি। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে কিছুটা বাঙালি হয়ে উঠি। বাকি দিনগুলোয় বাংলাকে কতখানি গুরুত্ব দিই? ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের খুব জনপ্রিয় একটা ছড়া, ‘জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’। অর্থাৎ, কোনও মা খুব গর্ব করে বলছেন, তাঁর ছেলে বাংলাটা ঠিক বলতে বা পড়তে পারে না। যেটা লজ্জার কথা, সেটাই আজ আমাদের গর্বের তিলক হয়ে উঠছে।
বাংলা মাধ্যম স্কুলের প্রতি অনীহা এসেছে বহুদিন ধরেই। ইংরাজি মাধ্যমে না পড়ালে লোকসমাজে মান ইজ্জত হলে কিছু থাকে না। বাঙালির বিয়ে বাড়িতে এখন মেহেন্দি আর জলসা ঢুকে পড়েছে। সিরিয়াল আর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সেইসব ‘সেলিব্রেশন’ দিব্যি ছড়িয়ে পড়ছে। কলকাতার মাল্টিপ্লেক্সে হিন্দির দাপটে বাংলা ছবি জায়গাই পায় না। পেলেও এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই হল থেকে তা ভ্যানিস হয়ে যায়। কলকাতার এফএম চ্যানেলে বাংলা গান না বাজারই মতো। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হোক বা সেন্ট্রাল পার্ক, সকালে হাঁটতে গেলে মনেই হবে না, আপনি বাংলায় আছেন। সবথেকে বড় কথা, দু’জন বাঙালিও নিজেদের মধ্যে কী অবলীলায় জটায়ুর মতো ভুলভাল হিন্দিতে কথা বলে চলেছেন।
এই ভাষা দেশকে জনগণমন ও বন্দেমাতরম দিয়েছে। এই ভাষা দেশকে সাহিত্যে একমাত্র নোবেল দিয়েছে। এই ভাষা দেশকে প্রথম অস্কার এনে দিয়েছে। তারপরেও নিজের ভাষাকে খাটো করার এমন চেষ্টা বোধ হয় বাঙালিই করতে পারে। তাই একটা নববর্ষ বা একটা একুশে ফেব্রুয়ারি শখের বাঙালি হয়ে উঠলে হবে না। বছরের বাকি দিনগুলোতেও বাঙালি হয়েই থাকতে হবে। বাঙালি হিসেবেই গর্ববোধ করতে হবে। এটাই হোক এবারের একুশের অঙ্গীকার।