‌ট্রেনের সেই আজব ভদ্রলোক

গৌতম রায়

দূরপাল্লার ট্রেনে ওঠার পর কিছু মানুষ ট্রেনের কামরাকে নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলেন। ঘটনাটা একটু খুলে বলি। একবার দার্জিলিং মেলে বাড়ি ফিরছি। ওদিকের লোয়ার বার্থে এক ভদ্রলোক উঠেছেন। ট্রেনে উঠেই উনি ব্যাগ থেকে গামছা বের করে বাথরুমে গেলেন। যখন ফিরলেন, দেখলাম খালি গায়ে শুধু একটা গামছা পরে ফিরলেন। ভদ্রলোকের চুল ভিজে, শরীর ভিজে, গামছাও ভিজে। স্নান করেছেন বুঝলাম, কিন্তু কীভাবে করেছেন বুঝলাম না। মগ তো সঙ্গে নিয়ে যাননি! তবে কী ওই চেন বাঁধা মগ দিয়েই… যাক গে! আমার কী?

এরপর উনি ব্যাগ থেকে একটা লুঙ্গি বের করলেন, গামছার ওপর দিয়ে পরে নিলেন। ভেজা গামছাটা দিয়ে গা হাত পা ভাল করে মুছলেন। একটা ফুটোওয়ালা স্যান্ডো গেঞ্জি পরলেন। গেঞ্জির ফুটোটা বড়ো অদ্ভুত জাগায়। ছোটবেলায় কোনও বন্ধু খুব আস্তে আস্তে কথা বললে, বন্ধুর ভ্যলিউম বাড়ানোর জন্য আমরা ছেলেরা ছেলেদের এক নির্দিষ্ট জাগায় প্যাঁচ দিতাম। হ্যাঁ, ওখানেই ওনার গেঞ্জির ফুটো, সেখান থেকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রয়েছে ওনার মাঝারি উচ্চতার ভ্যলিউম বটন। ওনার তাতে অবশ্য কোনও বিকার নেই, বুঝলাম উনি গেঞ্জির ওই ফুটোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছেন। এরপর উনি খুব সাবলীল ভাবে ব্যাগের ভিতর থেকে বের করে আনলেন একটা তেলের শিশি। সিটের ওপর আয়েশ করে বসে হাতে একটু একটু করে তেল ঢেলে উনি মেখে নিলেন মাথায় মুখে হাতে পায়ে। তেলের গন্ধ ম-ম করে উঠল গোটা কম্পার্টমেন্ট। আমরা সবাই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি ওনাকে। ওনার তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই অবশ্য।

তেল মাখা শেষ হতেই উনি ব্যাগ থেকে একটা সরু দড়ি বার করলেন, বেঁধে দিলেন দুটো আপার বার্থের সাপোর্টিং চেনে। মেলে দিলেন ভেজা গামছা। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম, ভাগ্যিস ভদ্রলোক স্নান করতে গিয়ে জাঙ্গিয়া ভেজাননি! ভদ্রলোক এরপর ব্যাগ থেকে একটা চাদর আর বালিশ বার করে চাদরটা পেতে আর বালিশটায় হ্যালান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন। হাত চলে গেল লুঙ্গির বিশেষ জাগায়। তারপর কী চুলকানি, কী চুলকানি! আরামে ভদ্রলোকের চোখ বুজে এল। দিগ্বিদিক ভুলে উনি চুলকাতে চুলকাতে বোধহয় পৌঁছে গেছিলেন স্বর্গের দ্বারে। একবার স্বর্গের সামনের দ্বার চুলকান তো একবার পিছনের দ্বার। মাঝে মাঝে বেদম হাওয়া চললে দেখা যাচ্ছে দ্বারের ভিতরের সেনাপতিকে।

মিনিট দুয়েক পর উনি চোখ খুললেন, ধ্যান ভঙ্গ হল। এবার উনি ফোন বের করলেন। কিছুক্ষণ টেপাটিপির পর কাউকে একটা ফোন লাগালেন। ওই পাড় থেকে ফোনটা উঠতেই উনি এই পাড় থেকে তারস্বরে বললেন, ‘‌হ্যালোওওওও! হ্যাঁ! হ্যাঁ! আমি ট্রেনে উঠে গেছিইইই। হ্যাঁ ফিরছি, আটটায় ছেড়েছে। হ্যালোওওও! হ্যাঁ, খাবার এনেছি। এবার খাবো। রাখছিইইই।’‌
কিছু একটা ছিল ওনার গলার আওয়াজে, আশেপাশের সব্বাইয়ের ইয়ে চমকে ইয়েতে চলে এল প্রায়। সে যাই হোক, এরপর উনি একটা খবরের কাগজ বের করে সিটের ওপর পেতে খাবার খেতে বসলেন। থালা, বাটি, চামচ, জলের গ্লাস সাজালেন প্রথমে। তারপর একে একে বেরোলো ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ, করোলা ভাজা, পনিরের তরকারি, মাছের ঝোল, ডিম কষা, দেশি মুরগির ফ্যামিলি, পাঁঠার পাল, ভেড়ার চোদ্দ গুষ্টি, দই, মিষ্টি, আইসক্রিম, পান মশলা ইত্যাদি। মোবাইলে পুরানো দিনের একটা বাংলা গান তারস্বরে চালিয়ে, উনি খেতে বসলেন। গান চলছে, ‘আমি এক যাযাবর, আমি এক যাযাবর-
পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর।’‌ গানের শেষদিকে একটা লাইন ছিল, ‘‌আপন হয়েছে পর’‌।
আমি মনে মনে ভাবলাম আপনদের কোনও দোষ নেই ভাই, তোমাকে পর করে দেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

এতক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতি ওনার অনুকূলেই ছিল, কিন্তু ব্যাঘাত ঘটল একটু পরেই। খাবার খেয়ে উনি হাত মুখ ধুয়ে এলেন। ভেজা গামছায় মুখ আর হাত মুছে নিয়ে ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে উনি কিছু একটা বার করলেন। তারপর সেটাকে লুঙ্গির কোমরের ভাঁজে গুঁজে গেলেন গেটের দিকে। একটু পরেই গোটা ডিব্বা বিড়ির গন্ধে মেতে উঠল। নাহ! আর নেওয়া যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবলাম, এবার কিছু একটা করতেই হবে। উঠতে গিয়েই, গন্ডগোলের গলা পেলাম গেটের দিক থেকে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম, RPF ধরেছে, বিড়ি সমেত।
ভদ্রলোক খুব ধমক টমক খেলেন। ফাইন টাইন ভরলেন। পুলিশ গামছা টাঙানো দেখে, গামছাটা দড়ি সমেত খুলে দিলেন। ‘‌ঘর সামঝা হে? ট্রেন মে গামছা টাঙায়গা? বিড়ি পিয়েগা? অউর ইয়ে কেয়া গেঞ্জি পেহনা হে? বন্ধ করো ইসকো… ’‌

ওনারা চলে যাওয়ার পর উনি সিটের ওপর মন মরা হয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসলেন। তারপর ফোনটা হাত থেকে কানে নিয়ে স্বর্গের সামনের দ্বার চুলকাতে চুলকাতে হঠাৎ তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‌হ্যালোওওওওও…’‌

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.