মানস বরাট
হয়ত শিরোনাম দেখে অনেকে অবাকই হবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, এইমুহূর্তে এটাই জরুরি। আমরা ছোট বেলা থেকেই গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছি। কোনও কোনও স্যার থাকতেন, যাঁরা মারধর করতেন। আমরা ভয় পেতাম। কী জানি, সেই কারণেই হয়ত তেমন দুষ্টুমি করতাম না।
এখন যখন পুরানো কথাগুলো ভাবতে বসি, মনে হয় তাঁরা বোধ হয় ঠিকই করতেন। সেই স্যারদের প্রতি শ্রদ্ধা এতটুকুও কমে যায়নি। মনে হয়, সেই অনুশাসনটা খুব জরুরি ছিল। শিক্ষকরা মেরেছেন শুনে আমাদের বাবা-মারাও কিছু মনে করতেন না। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, শিক্ষক মশাই আমাদের ভাল চান বলেই শাসন করেন। আজ নিজে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। নিজে যখন ছাত্রদের পড়াই, তখন সেই মাস্টামরশাইদের মুখগুলো খুব মনে পড়ে।
মনে হয়, তাঁরা যেটা করতেন, আমাদেরও বোধ হয় সেটাই করা উচিত। কিছু কিছু ছাত্র এমন কাজ করে, তাদের না পেটালে তারা শোধরাবে না। আমাদের সময়ে মোবাইল জিনিসটা কী, তাই জানতাম না। এই শব্দটাও শুনিনি। কিন্তু এখন ছেলেরা ক্লাসে মোবাইল নিয়ে আসছে। সারাক্ষণ পেছনের বেঞ্চে বসে মোবাইল নাড়াচাড়া করছে। কেউ সোশাল সাইটে মগ্ন, কেউ মগ্ন ইউ টিউবে, আবার কেউ চুপি চুপি মেয়েদের ছবি তুলে যাচ্ছে।
এবার শিক্ষক কী করবে? পড়ানোয় মন দেবে নাকি কে মোবাইলে কী করছে, সেদিকে নজরদারি চালাবে? ব্যাপারটা এক-দুজন ছাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। ক্রমশ সংক্রামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দুজনের দেখাদেখি, এখন অনেকেই মোবাইল আনছে। ক্লাসের মাঝেই দিব্যি চলছে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া।
দু একজনকে ধমক দিলাম। কোনও লাভ হল না। একজনকে একটা চড় মারলাম। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে গেল। শাসকদলের নেতারা হাজির। কেন ছাত্রের গায়ে হাত তুলেছি, সেই কৈফিয়ত চাইতে লাগল। হুমকি দেওয়া হল, থানায় এফ আই আর করা হবে। শেষপর্যন্ত হেড স্যারের হস্তক্ষেপে জল বেশিদূর গড়ালো না।
যা বুঝলাম, ক্লাসের মাঝে ছাত্রদের মোবাইল চর্চায় কোনও অন্যায় নেই। আমি কেন মারলাম, সেটা নিয়েই সবাই বেশি সোচ্চার। কেউ কেউ জ্ঞান দিল, বোঝাতে পারতেন, মারার অধিকার কে দিয়েছে? অন্যান্য শিক্ষক বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাদেরও কম-বেশি একইরকম অভিজ্ঞতা। তারাও বেশ বিরক্ত। কিন্তু অসহায়।
পরিস্থিতি ক্রমশ আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। গার্জেনদের অনুরোধ, ছেলের হাতে মোবাইল দিয়ে স্কুলে পাঠাবেন না। ওটা পড়াশোনার কোনও কাজে লাগে না। আপনার ছেলে বা মেয়ে যদি মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে জেনে রাখুন, তার পড়াশোনা গোল্লায় যেতে বেশি সময় লাগবে না।
সরকারের কাছেও অনুরোধ, শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষকদের আরও কিছু অধিকার দেওয়া হোক। পাশফেল ফিরে আসছে, ভাল কথা। এবার মারও ফিরে আসুক। ছাত্ররা আমাদের সন্তানতূল্য। তাদের গায়ে হাত তুলতে আমাদের ভাল লাগে না। কিন্তু কখনও কখনও বিকল্প কোনও উপায় থাকে না। প্যাঁদানি ছাড়া অন্য কোনও দাওয়াই কাজ করে না।
আমাদের শিক্ষকরাও আমাদের মারতেন। ভালবাসতেন, আমাদের ভাল চাইতেন। তাই তাঁরা মারলেও কখনই তাঁদের শত্রু বলে মনে হয়নি। বরং, যত দিন যাচ্ছে, তত শ্রদ্ধা বেড়েছে। মনে হয়েছে, সেদিন তাঁরা বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেই বলেই বোধ হয়, কিছুটা ঠিক পথে চলেছি। আমাদের ছাত্রদের যদি ঠিকপথে চালনা করতে হয়, তাহলে শুধু বুঝিয়ে হবে না। একটু আধটু পিটুনি সত্যিই খুব জরুরি।
(লেখক একজন হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। আপনি একমত হতেও পারেন, নাও পারেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত জানিয়েও লেখা পাঠাতে পারেন। শিক্ষা সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যার নিয়েও খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন। ঠিকানাঃ bengaltimes.in@gmail.com)