( কয়েক বছর আগে, জ্যোতি বসুর জন্মদিনে ইজেডসিসি-তে একটি অনুষ্ঠান। সেখানে জ্যোতি বাবুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন বর্ষীয়াণ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। একেবারে ভিন্নধর্মী একটি ভাষণ। বেঙ্গল টাইমসে সেই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এখনও মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আপন খেয়ালে লেখাটি ঘুরে বেড়ায়। সেই লেখাটি তুলে ধরা হল।)
১) রবীনবাবু আমার বাড়িতে গিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি বলেছিলাম, যাব। তবু বয়স বাড়ছে তো। শরীর তেমন সঙ্গ দিচ্ছে না। আসতে পারব কিনা নিশ্চিত ছিলাম না। শেষপর্যন্ত কিছুটা জেদ করেই চলে এলাম। এই জেদ বাড়িয়ে দিল একটি টিভি চ্যানেল। তারা নানা রকম উল্টোপাল্টা প্রশ্ন শুরু করে দিল। কেন আপনি যাবেন, জ্যোতি বসুর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক। রীতিমতো ধমক দিতে শুরু করল। তখন আমারও জেদ চেপে গেল। আর বাঙালের জেদ চাপলে কী হয়, তা তো জানেন। চলে এলাম।
২) জ্যোতি বাবুর দাদা-বউদি আমার মক্কেল ছিলেন। তাঁর ভায়রাভাইও আমার মক্কেল। অতি সজ্জন মানুষ। তাঁদের কাছে জ্যোতি বাবুর অনেক কথা শুনেছি।
৩) আমি যেসব কথা বলব, তা একটু অন্যরকমের। বাকি যাঁরা আছেন, তাঁরা অনেক গুণী মানুষ। তাঁরা অনেককিছু জানেন। অনেকেই সুবক্তা। তাঁরা সেসব কথা বলবেন। আমি বরং আমার মতো করে বলি।
৪) আমার কাছে জ্যোতিবাবু বনের এক বড় বাঘের মতো। আমি জঙ্গলে ঘোরাফেরা করি। তাই আমি আমার ভাষাতেই বলি। সেই বাঘ, যাকে গোটা জঙ্গল সমীহ করে। যাকে অনেকের মাঝেও আলাদা করে চেনা যায়।
৫) প্রবল তাঁর ব্যক্তিত্ব। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। কিন্তু যখন বলতেন, সেটাই হত শেষ কথা। সচরাচর তিনি হাসতেন না। কিন্তু যখন হাসতেন, সেই হাসি দেখলে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েও প্রেমে পড়ে যেত।
৬) আপনারা যাই বলুন, উনি বক্তৃতা একদম ভাল দিতেন না। কোনও বাক্য সম্পূর্ণ করতেন না। আমি বললাম, ওরা বলল, এই সব বলতেন। কিন্তু যাদের জন্য বললেন, তাঁরা ঠিক বুঝতেন। কী বলতে চাইছেন, তা নিয়ে কোনও অস্পষ্টতা ছিল না।
৭) এখনকার রাজনীতিকদের দেখি। এখন রাজনীতি ভাল একটা প্রফেশন। এত সহজে এত রোজগার আর কোনও প্রফেশনে হয় না।
৮) একজন বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার। চাইলে কী আরামে জীবনটা কাটাতে পারতেন! কিন্তু কালো কোট তুলে রেখে তিনি নেমে পড়লেন লড়াই সংগ্রামে। জ্যোতিবাবুর মতো লোকেরা টাকার জন্য, গাড়ি-বাড়ির জন্য রাজনীতিতে আসেননি। সারা জীবন একটা মূল্যবোধের রাজনীতি করে গেছেন। একটা আদর্শের জন্য লড়াই করেছেন।
৯) হয়ত তাঁর সব ভাবনা সব সময় সঠিক ছিল না। কোনও কোনও বিষয় নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। আমিও নানা সময়ে সমালোচনা করেছি। কিন্তু সেই ভাবনার মধ্যে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর আন্তরিকতা বা সদিচ্ছা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না।
১০) জ্যোতিবাবুর চেলাদের কথা একটু বলি। অনেকেই এই মঞ্চে আছেন। এই যে বিমান বাবু। সারা জীবন বিয়েই করলেন না। সাদাসিধে মানুষ। খালি রুমাল হারিয়ে ফেলেন। একবার বইমেলায় একসঙ্গে অনেকক্ষণ ছিলাম। পকেট হাতড়াচ্ছেন, রুমাল খুঁজে পাচ্ছেন না। আমার কাছে দুটো রুমাল ছিল। একটা ওনাকে দিলাম। বললাম, রুমাল দিতে নেই। এটা কিন্তু ফেরত দেবেন। উনি বললেন, আপনার জন্য আমি এক ডজন ভাল রুমাল এনে দেব। কত বছর পেরিয়ে গেল। আজও সেই রুমাল উনি দিলেন না। যাঁরা এত ভাল কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাঁদের এমন ছোটখাটো ভুল ধরতে নেই। ওনার দুটো মস্তবড় দোষ। সারাজীবন বিয়ে করলেন না। দুই, মেয়েদের সম্পর্কে কোনও আকর্ষণ আছে বলেও মনে হয় না। এই দুটোকে অনেকে বলবেন গুণ। আমি দোষই বলব। তবে যাঁদের এতরকম গুণ থাকে, তাঁদের এমন দু একটা দোষ থাকলে ক্ষতি নেই। এই দুটো দোষ আছে বলেই উনি এত মানুষের কাজ করতে পারছেন।
১১) এই যে বুদ্ধবাবু। খুব পড়াশোনা করেন। জ্যোতিবাবুকে কিছু বললেই উনি বলতেন, ওটা বুদ্ধ জানে। ও খুব পড়াশোনা করে। পড়াশোনা একটা মহৎ গুণ। বামপন্থীদের সঙ্গে পড়াশোনার একটা গভীর সম্পর্ক আছে। বুদ্ধবাবুর আরেকটা পরিচয় আপনারা জানেন না। আপনারা জানেন না উনি কোন পরিবারের ছেলে। একবার উনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আমার লেখার টেবিলে পুরোহিত তর্পন দেখে বললেন, এটা নিয়ে আপনি কী করছেন? আমি বললাম, আমি মূর্খ মানুষ। বেশি কিছু জানি না। এখান থেকে টুকি, ওখান থেকে টুকি। সেদিন জেনেছিলাম, এই পুরোহিত তর্পনের লেখক তাঁর নিজের জ্যাঠামশাই? বুদ্ধবাবুকে নিজের মুখে এটা কোনওদিন বলতে শুনেছেন? মানুষটা বড় অন্তর্মুখী। এটা মস্তবড় গুণ, আবারও দোষও। কারণ, রাজনীতি করতে গেলে এত অন্তর্মুখী হলে চলে না, একটু বহির্মুখী হতে হয়।
১২) আমার বাঁদিকে আছে সীতারাম। এঁকে আপনারা সবাই চেনেন। আমি চিনি অনেকদিন ধরে। আমার মেয়ে জে এন ইউ-তে পড়ত। আর জে এন ইউ-র এক উজ্জ্বল ছাত্র সীতারাম ইয়েচুরি। এখনও যদি জে এন ইউ-তে যান, বুঝতে পারবেন সবাই ওকে কী শ্রদ্ধার চোখে দেখে। চাইলে, দেশ–বিদেশের বড় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারত। সে পথে গেলই না। ওর আরেকটা পরিচয় আপনারা জানেন না, ও ভয়ঙ্কর এক লেডিকিলার। এমন সুন্দর দেখতে একটা ছেলে, লেখাপড়ায় দারুণ, বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ জ্ঞান, দারুণ কথা বলে। তার প্রেমে মেয়েরা পড়বে না! সেই সময় কত মেয়ে যে ওর জন্য পাগল ছিল, তা যদি জানতেন!
১৩) আমার ডানদিকে সূর্যকান্ত মিশ্র। ডাক্তার মানুষ। ভদ্র, বিনয়ী। সুবক্তা। আলাপ ছিল না। আজই আলাপ হল। কিন্তু তাঁকেও চিনি অনেকদিন ধরে। এমন ভাল ডাক্তার। কত টাকা পয়সা করতে পারতেন। কিন্তু উনিও তাই। মাঠে ঘাটে সাধারণ মানুষের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
১৪) জ্যোতিবাবুর কথা বলতে গিয়ে তাঁর চেলাদের কথা এত বলছি কেন? কারণ, একটা মানুষ কেমন, সেটা তাঁর সঙ্গীসাথীদের দেখেই বোঝা যায়। এই যে এতজনের কথা বললাম, এঁদের কাউকে আপনি অসৎ বলতে পারবেন না। এঁরা কেউ কিন্তু গাড়ি, বাড়ি বা টাকার জন্য রাজনীতি করতে আসেননি। অন্য পেশায় অনেক সফল হতে পারতেন। সব হাতছানি ছেড়ে এসেছেন। জ্যোতিবাবু ছিলেন এঁদের নেতা। এঁদের দেখেই বোঝা যায়, জ্যোতিবাবু কেমন ছিলেন।
******