হেমন্ত রায়
একবার একটা সেমিনারে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, যতরকম ভ্রমণ কাহিনী পড়েছি, তার মধ্যে সেরা হল সৈয়দ মুজতাবা আলির দেশে বিদেশে। শুধু বাংলা ভাষা নয়, পৃথিবীর কোনও ভাষায় এই ধরনের বই লেখা হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বাঙালিরা এই বইটি সেভাবে পড়েই দেখল না।
আজ সেই সৈয়দ মুজতাবা আলির জন্মদিন। দেশে বিদেশে এখনও কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়। রাস্তায় ঢেলে যেসব বই বিক্রি হয়, সেই স্তূপ ঘাঁটলে হয়ত পেয়েও যাবেন। অনেক জায়গাতেই এরকমভাবেই পড়ে থাকতে দেখেছি মূল্যবান এই বইটি। প্রথমে রাস্তা থেকেই বইটি কিনেছিলাম। পরে এক বন্ধুকে দেওয়ার জন্য আরও একবার কিনেছিলাম। সেবারও রাস্তা থেকে। অনেক ভেবে দেখেছি, বইটি রাস্তার ধারে এত বেশি পাওয়া যায় কেন?
আসলে, অতীতে এই বই লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। যাঁরা কিনেছেন, কদর বুঝেই কিনেছেন। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর পরবর্তী প্রজন্ম এর মূল্য বোঝেনি। ঘর সাফাইয়ের নাম করে কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছেন।
অমর্ত্য সেনের ওই সেমিনারে হাজির হওয়ার সুযোগ না হলে হয়ত আমারও ওই বই কেনাই হত না। হয়ত ওই বই কেনার কথা ভাবতামও না। কত লোকেই তো কত বই লেখে। কটা বইয়ের খবর আমরা রাখি! বইটা পড়ার পর বুঝেছিলাম, কী অমূল্য এক সম্পদ। কিন্তু ভারী অবাক করার মতো বিষয় হল, বইটা লিখেছিলেন আফগানিস্তানে কাটিয়ে আসার অন্তত কুড়ি বছর পর। প্রথমে বেরিয়েছিল দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে। পরে সেটাই বই হিসেবে হাজির হয়। নিশ্চয় সাল–তারিখ লেখা ছিল। নিশ্চয় কোনও ডায়েরির সাহায্য নিয়েছেন। পাঠক হিসেবে সবার আগে এটাই মনে হওয়ার কথা। কিন্তু ভারী অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন মুজতাবা আলি। তাঁর কোনও ডায়েরি ছিল না। কোথাও কোনও তথ্য লিখেও রাখেননি। কুড়ি বছর পর, পুরোটাই লিখেছিলেন নিজের স্মৃতি থেকে।
তিনি বলেছিলেন, যে মুহূর্তে তুমি কোনও ঘটনা লিখে রাখবে, জানবে তোমার মাথা থেকে সেটা হারিয়ে গেল। তুমি নিজের স্মৃতির ওপর ভরসা করতে পারোনি বলেই লিখে রাখতে হয়েছে। তুমি জানো, সেটা লেখা আছে, সময় হলে দেখে নেওয়া যাবে, তাই তুমি পরে সেটা ভুলে যাও। কিন্তু যখন তুমি লিখে রাখবে না, তখন তা তোমার স্মৃতিতে থেকে যাবে। এভাবেই অনেক বিষয় স্মৃতিতে সাজিয়ে রাখতে হয়।
কথাটা আপাতভাবে খুবই সামান্য। কিন্তু তাৎপর্যটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমরা অনেক জিনিস লিখে রাখি। মাথা থেকে হয়ত সেগুলো সত্যিই হারিয়ে যায়। আসলে, আমরা বোধ হয় স্মৃতির ওপর ভরসা রাখতেই শিখিনি। দেশে বিদেশে–র সাহিত্য গুণ কেমন, তা গুণী মানুষেরা বিচার করবেন। কিন্তু শুধু স্মৃতির ওপর ভরসা করে এমন বই লেখা যায়! এই কারণেই বোধ হয় অন্যদের থেকে তিনি অনেকটা এগিয়ে।