রক্তিম মিত্র
মাঝে মাঝেই শোনা যায়, স্পিকারের পদটা সাংবিধানিক পদ। সম্মানীয় পদ। তাই স্পিকার সম্পর্কে সমালোচনা করা যাবে না।
মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করা যাবে। রাজ্যপালের নামে যা খুশি বলা যাবে। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিরও সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু স্পিকার নিয়ে নাকি কিছু বলা যাবে না। টিভির সান্ধ্য বিতর্কে মাঝে মাঝেই এমনটা শোনা যায়। স্পিকার নিয়ে কেউ কিছু বলতে গেলে সঞ্চালকও থামিয়ে দেন।
আগে মনে হত, স্পিকার নিয়ে সমালোচনা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ওই পদটাকে অন্তত বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখাই উচিত। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সেই ধারণাটা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সবার সমালোচনা হলে স্পিকারই বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকবেন কেন? বিশেষ করে তিনি যদি লাগাতার এমন আজগুবি সব কাণ্ড করে যান।
মানছি, ওই চেয়ারটা খুব সম্মানের। কিন্তু যিনি ওই চেয়ারে বসছেন, সম্মানরক্ষার দায়িত্ব তো তাঁরও। শুধু বাইরের লোকেরা সেই চেয়ারকে সম্মান দেখিয়ে যাবেন, আর যিনি চেয়ারে বসছেন, তিনি বছরের পর বছর ওই চেয়ারকে কলঙ্কিত করে যাবেন, একের পর এক ন্যক্কারজনক আচরণ করে যাবেন, এটা তো হতে পারে না। যিনি ওই চেয়ারে বসছেন, তিনি যদি নিজের চেয়ারকে সম্মান দিতে না শেখেন, লোকের কী দায় পড়েছে সম্মান দেওয়ার!
গত বারো–তের বছর ধরে গিলোটিন শব্দটা বাংলা বিধানসভার অপরিহার্য একটা শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, বাজেটে তিন–চারটি বিষয় নিয়ে নম নম করে আলোচনা হবে। বাকি প্রায় পঞ্চাশখানা দপ্তর আলোচনা ছাড়াই পাস হয়ে যাবে। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা–সহ পঞ্চাশটির বেশি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের বাজেট নিয়ে ন্যূনতম আলোচনাও হল না। সেই বাজেট পাস হয়ে গেল। অর্থাৎ, পঞ্চাশের বেশি দপ্তরের বাজেট গিলোটিনে চলে গেল।
আগে বাজেট অধিবেশন চলত একমাসের বেশি সময় ধরে। প্রায় সব দপ্তর নিয়েই দীর্ঘ আলোচনা, বিতর্ক হত। কোনও কোনও বিষয় নিয়ে তো তিনদিন, চারদিনও আলোচনা হত। কিন্তু সেসব পাঠ বিধানসভা থেকে কবেই উঠে গেছে। হয়ত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব আলোচনা করা গেল না, তখন বিরোধীদের সম্মতি নিয়ে হয়তো একটা বা দুটো দপ্তর অল্প সময়ের আলোচনা হত। বা আলোচনা ছাড়া পাস হত। সেটা হয়তো উদ্যান পালন বা প্রাণী সম্পদ বিকাশ এই জাতীয় দপ্তর। কিন্তু এখন শিক্ষা, পঞ্চায়েত, পুলিশ, স্বাস্থ্য— সবই গিলোটিনে যায়।
এই গিলোটিনে পাঠানো— এটা নাকি স্পিকারের বিশেষ এক্তিয়ার। তিনি বিশেষ ক্ষমতাবলে এটা করতে পারেন। কী নির্লজ্জের মতো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সবাই সেসব ব্যাখ্যাও শুনেও নেয়। বিজনেস অ্যাডভাইসারি কমিটির মিটিংয়েও এই খামখেয়ালিপনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। মিডিয়াতেও ব্যাপারটা গা সওয়া। এটা নিয়ে তেমন কোনও উচ্চবাচ্যও হয় না। যেন, খুব সাধারণ একটা বিষয়। যেন খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়।
আসলে, পরিষদীয় রাজনীতি নিয়ে ন্যূনতম ধারণা ও শ্রদ্ধা না থাকলে, তবেই এমনটা করা যায়। তবেই এমন ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায়। আসলে, আগে কীভাবে বিধানসভা চলত, সে সম্পর্কে এই স্পিকারের কোনও ধারণাই নেই। সেই সময় অধিবেশন হয়তো দেখেননি। কিন্তু স্পিকার হওয়ার পর তো পুরনো প্রসিডিংস পড়ে দেখতে পারতেন। যদি একদিনও পড়তেন, কাউকে বলতে হত না, তিনি নিজেই বুঝতে পারতেন, এই চেয়ারে তিনি কতটা অযোগ্য।
আমরা শাজাহানদের কাণ্ডকারখানা শুনে রেগে যাই। আমরা পার্থ চ্যাটার্জিদের অপকর্ম শুনে রেগে যাই। এই স্পিকারের এমন অর্বাচীন আচরণের পর আমাদের রাগ হয় না কেন? এতগুলো দপ্তরকে গিলোটিনে পাঠানো খুন বা ধর্ষণের থেকে কোনও অংশে কম অপরাধ নয়। বরং এই অপরাধের মাত্রা অনেক বেশি। শুনতে হয়তো খটমট লাগবে। মনে হবে, একটু বাড়াবাড়ি। আসলে, এই মানুষটির জন্য আমাদের মনে এখনও তেমন রাগ বা ঘৃণা তৈরি হয়নি। এর কারণ আমাদের সহিষ্ণুতা নয়। এর কারণ আমাদের নিরেট অজ্ঞতা।
না, দোষটা স্পিকার মশাইয়ের নয়। তিনি কিন্তু বছরের পর বছর এই ‘গিলোটিন’ এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। গিলোটিনে পাঠানোর রেকর্ডও করে ফেলেছেন। তিনি কতখানি অর্বাচীন, এই নমুনা তিনি রেখেই চলেছেন। বুঝিনি আমরাই। এ দায় একান্তই আমাদের।