সরোজ চক্রবর্তী
হয় ইউরোপ। নইলে লাতিন আমেরিকা। বিশ্বকাপ বরাবর এই দুই হাতেই ঘোরাফেরা করেছে। এই দুই ঠিকানার বাইরে সে যেতেই চায় না। এই দুই মহাদেশ যদি কুলীন ব্রাহ্মণ হয়। এশিয়া বা আফ্রিকা যেন নেহাতই ব্রাত্যজন। এশিয়ার দুই দেশ (জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) গ্রুপ লিগে একের পর এক চমক দেখিয়ে উঠে এসেছিল নকআউটে। কিন্তু সেখানেই তাদের দৌড় থেমে গেল। প্রি কোয়ার্টার থেকে কোয়ার্টার। আবার কোয়ার্টার থেকে সেমিফাইনাল। দুই ধাপ উঠে এসে প্রবলভাবে লড়াইয়ে আছে মরক্কো। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার বাইরে একমাত্র প্রতিনিধি তারাই।
মরক্কো যে এতদূর উঠে আসবে, কে ভেবেছিল! অন্যদের কথা ছেড়েই দিন, তারা নিজেরাও কি ভাবতে পেরেছিল? এখনও পর্যন্ত এবারের বিশ্বকাপের সেরা চমক এই মরক্কোই। শেষ চারের লড়াইয়ে তাদের সামনে ফ্রান্স। সেই ফ্রান্স, চার বছর আগে রাশিয়ার বিশ্বকাপে যাদের মাথায় উঠেছিল রাজমুকুট। করিম বেনজিমা, কন্তেরা ছিটকে যাওয়ার পরেও মসৃণ গতিতেই এগোচ্ছে ফ্রান্স। মেসি, নেইমার, রোনাল্ডোদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে নায়ক হয়ে উঠেছেন কিলিয়ান এমবাপে। গোল সংখ্যার হিসেবে এখনও তিনিই এগিয়ে। সোনার বুটের জোরালো দাবিদার।
একটা নিবিঢ় বন্ধুত্বের কথাও এই সুযোগে তুলে ধরা যাক। আসরাফ হাকিমি। মরক্কো রক্ষণের স্তম্ভ। ফ্রান্সের পিএসজিতে খেলেন এমবাপের সঙ্গেই। দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব। হাকিমি যখন এমবাপেকে ঈদের ‘দাওয়াত’ দিচ্ছেন, তখন এমবাপে হাকিমিকে ফরাসি শেখাচ্ছেন। রক্ষণ থেকে এমবাপের দিকে বল বাড়াচ্ছেন হাকিমি, সেই পাস থেকে গোল করে ছুটে আসছেন এমবাপে। ক্লাব ফুটবলে এমন দৃশ্য কতবার দেখা গেছে। কিন্তু এ যেন অন্য আঙিনা। অন্য পটভূমি। এখানে হাকিমির ওপর দায়িত্ব থাকবে এমবাপের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার।
মরক্কো দেশটা ভারতের তিন ভাগের একভাগ। আর জনসংখ্যা? সাড়ে তিন কোটিরও কম। মানে, পশ্চিমবঙ্গের তিন ভাগের একভাগ। মরক্কোকে আফ্রিকার দেশ বলা হচ্ছে ঠিকই। ভৌগোলিকভাবে অবশ্যই আফ্রিকার। তবে এই দেশ স্পেন বা পর্তুগালের এতটাই কাছে যে, ইউরোপীয় ঘরানার প্রভাব স্পষ্ট। জিব্রালটারের জলপথে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। অনেকটা কলকাতা থেকে কল্যাণী বা বর্ধমানের মতোই। এদেশ–ওদেশ আখছার যাতায়াত লেগেই আছে। এক মহাদেশের লোক প্রায় অন্য মহাদেশে বাজার করতে যাওয়ার মতোই। দুই দেশ এত কাছাকাছি হলে যা হয়! মিশ্র সংস্কৃতির একটা প্রভাব এসেই যায়। মরক্কোর ছেলেরা পড়তে যাচ্ছে স্পেন বা পর্তুগালে। যারা ফুটবল খেলে, তারা স্পেনে বা পর্তুগালে ক্লাব খুঁজে নেয়। এই দলেই ১৬ জন খেলেন ইউরোপে বিভিন্ন ক্লাবে। তাই সেদিক থেকে মরক্কো যতটা আফ্রিকা ঘরানার, ততটাই ইউরোপীয় ঘরানার। অবশ্য এই ইউরোপীয় ঘরানা শুধুমাত্র ভৌগোলিক কারণে এসেছে এমন নয়। ১৯৫৬ তে মরক্কোয় ফুটবলের আসল যাত্রা শুরু হয়। সেবছরই তারা ফিফার অনুমোদন পায়। মরক্কোর বাদশা খুবই দূরদর্শী ছিলেন। বুঝেছিলেন, দেশটাকে ফুটবলে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ইউরোপের ঘরানা আনতেই হবে। সে বছরই চালু হল মরক্কোর লিগ। দশটা ক্লাবেই আনা হল ইউরোপের দশজন কোচকে। সব খরচই বহল করলেন বাদশা। ২০ বছর পরই আফ্রিকান নেশনস কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শোরগোল ফেলে দিল মরক্কো। যদিও বিশ্বকাপের দরজা খুলেছে ১৯৮৬ তে। সেবার গ্রুপ লিগে ইংল্যান্ড ও পোলান্ডের সঙ্গে ড্র, শেষ ম্যাচে পর্তুগালকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছে গিয়েছিল মরক্কো। নকআউটে জার্মানির সঙ্গে দুরন্ত লড়াই করে হার। আবির্ভাবেই অনেকটা চমকে দিয়েছিল আফ্রিকার এই দেশটি। আর এবার তো একেবারে সেমিফাইনালে। ধারেভারে ফ্রান্স অবশ্যই এগিয়ে। কিন্তু বিশ্বকাপ তো কাগজ–কলমের হিসেবকে উল্টে দেওয়ারই মঞ্চ। একটা হিসেব উল্টে দিলেই খুলে যাবে ফাইনালের দরজা।
সহজ কথা, ট্রফি থেকে আর মাত্র দু’ধাপ দূরে। বিদায় নিলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। কিন্তু দুটো ধাপ উতরে গেলে নতুন ইতিহাসের হাতছানি। শুধু মরক্কোর জন্য নয়, বিশ্বকাপের জন্যও এ যেন এক সন্ধিক্ষণ। মরক্কো জিতলে ইউরোপ–লাতিন আমেরিকার গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বকাপ পাড়ি দেবে অন্য এক পৃথিবীতে। বলা যায়, বিশ্বকাপটাই জাতে উঠবে।