তৃণমূলের তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা এক বছর হয়ে গেল। এই এক বছরে কত ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরে এল। কত লোক ইট পেতে আছেন উন্নয়নে সামিল হওয়ার জন্য। বিজেপির বেলুন থেকে একটু একটু করে হাওয়া বের হচ্ছে। বামেরা একটু হলেও হারানো জমি ফিরে পাচ্ছে। যাঁরা বলছিলেন, পরিবর্তন অনিবার্য, তাঁরা নিজেদের মতকে দিব্যি গিলে ফেলছেন। কিন্তু যেটা ভেবেছিলাম, বলেছিলাম, সেটা স্বীকার করতে বাধা কোথায় ? স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সেই স্বীকারোক্তিই উঠে এল সরল বিশ্বাসের লেখায়।
এই সেদিন তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এল তৃণমূল। দেখতে দেখতে এক বছর পেরিয়ে গেল। সত্যিই, সময় কত দ্রুত প্রবহমান। রাজ্যজুড়ে এখন যেন একটাই দল। বিজেপি যত দিন যাচ্ছে, ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। তৃণমূল থেকে আসা একের পর এক নেতা ফের দলে ফেরার জন্য ইট পেতে রেখেছেন। অনেকে বহাল তবিয়তে ফিরেও গেছেন। বামেরা একটু একটু করে জমি ফিরে পাচ্ছে। কিন্তু বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে গেলে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
একবছর আগেও যে এমন তীব্র পরিবর্তনের হাওয়া উঠেছিল, এখনকার হাওয়ায় তা বুঝে ওঠাও মুশকিল। পথে ঘাটে, বাসে ট্রেনে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, এবার তৃণমূল সরকারের পতন নিশ্চিত। কিন্তু সেই কণ্ঠগুলো এখন কেমন বেমালুম সুর বদলে ফেলেছে। আমি অবশ্য সুর বদলের জন্য নয়, বরং একবছর আগে যেটা ভেবেছিলাম, সেটাই জোরের সঙ্গে বলতে চাই। সেই কারণেই এক বছর পূর্তিতে নতুন করে বেঙ্গল টাইমসে লিখতে বসেছি।
প্রথমেই অকপটে বলে রাখি, বিধানসভা নির্বাচনে আমার হিসেব একেবারেই মেলেনি। আর দশজনের মতো, আমিও ভেবেছিলাম, এবার রাজ্যে পরিবর্তন আসছে। বিজেপি দুশোর কাছাকাছি আসন পাবে। তৃণমূল হয়ত একশোর নিচে নেমে যাবে। শুধু ভেবেছিলাম বললে ভুল হবে। অনেকের কাছে নিজের এই মনোভাবের কথা জানিয়েও ছিলাম। এই হলে এই হবে, অমুক ভোট এত পার্সেন্ট সুইং হলে এই হতে পারে— এই জাতীয় ভাসা ভাসা মন্তব্য নয়। দুদিক খুলে রাখার চেষ্টাও নয়। সরাসরিই নিজের মত জানিয়েছিলাম। তাই পরে অন্যরা যতই ডিগবাজি মারুক, আমি অন্তত সেই ডিগবাজি মারতে পারব না। এত লোককে নিজের মতামত জানিয়েছিলাম, পাল্টি খাওয়ার উপায়ও নেই। এক বছর পরে হয়ত অনেকে ভুলে গেছে। কিন্তু আমি তো আমার সেই অবস্থানকে ভুলতে পারি না। তাই এক বছর পরেও অকপটেই স্বীকার করছি, আমার হিসেব একেবারেই মেলেনি।
কেন এমনটা মনে হয়েছিল? সত্যিই কি আমি বিজেপির সমর্থক? আমি কি অমিত শাহর কথায় (ইসবার দোশো পার) স্লোগানে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলাম? বিজেপির সংগঠন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে, এমনটা মনে করেছিলাম? বিজেপি এলে সুশাসন আসবে, এমনটা ভেবেছিলাম? এর কোনওটাই নয়। আমার ভোট প্রতিবারের মতো বামেই পড়েছিল। চিরদিন তাই পড়বে। কিন্তু তলায় তলায় প্রবল তৃণমূল বিরোধী হাওয়া টের পাচ্ছিলাম। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সেই বলছে বিজেপি জিতবে। এমনকী ছাপ মারা তৃণমূল কর্মীরাও চুপি চুপি জানিয়েছিলেন, হাওয়া গোলমেলে, এবার পদ্মফুলে মেরেছি। এই হাওয়ায় কিছুটা হলেও প্রভাবিত হয়েছিলাম।
কলকাতার মিডিয়া কী বলছে, বুথফেরত সমীক্ষা কী বলছে, তাকে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি। তবে, বাম ভোটের বড় একটা অংশ যে লোকসভার মতোই এই ভোটেও তলায় তলায় পদ্মশিবিরে গেছে, এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। এই সব কারণেই মনে হয়েছিল, তৃণমূল নিশ্চিতভাবেই হারছে। বিজেপির প্রতি কোনও দুর্বলতা বা সহানুভূতি ছিল না। তারা এলে ভাল সরকার চালাবে, এই বিশ্বাসটাও ছিল না। তারা জিতলেও এটাই বলতাম, হাওয়ায় জিতেছে। এর পেছনে তথাকথিত আরএসএসের ভূমিকা বা সাংগঠনিক দক্ষতা খোঁজার চেষ্টাই করতাম না। কারণ, বিজেপির আঠারো আসন জেতার পেছনেও তথাকথিত আরএসএস বা সংগঠনের তেমন কোনও ভূমিকাই ছিল না। জাস্ট তৃণমূল বিরোধী হাওয়ার সুফল পেয়েছিল বিজেপি।
অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, যেভাবেই হোক, বিজেপিকে আটকাতে হবে। এই অবস্থায় বামেদের ভোট দেওয়া মানে ভোট নষ্ট করা। বিজেপিকে আটকাতে তৃণমলে ভোট দিতে হবে? এই তত্ত্বেও ভরসা ছিল না। আমার অবস্থান ছিল খুব পরিষ্কার, আমার ভোট বামেই যাবে। তাতে বাম যদি সাত পারসেন্ট থেকে নেমে পাঁচ পার্সেন্টেও এসে যায়, তবু তার মধ্যে একটা ভোট আমার থাকুক। মনে হয়েছিল, বিজেপিকে আটকানোর ক্ষমতা হয়ত আমার নেই। কিন্তু নিজের ভোটটা নিজের পছন্দের দলকে দেওয়ার ইচ্ছেটুকু তো আছে। এই কঠিন সময়েও নিজের ভাল লাগাকেই আঁকড়ে থাকতে চাই। বিজেপি বিপজ্জনক বলে তৃণমূলের একের পর এক অপরাধকে ক্ষমার চোখে দেখতে হবে, এতখানি উদারতা আমার মধ্যে ছিল না। এখনও নেই। যদি বুঝতাম, তৃণমূল নিজেকে শুধরে নিতে পারে, তাহলে হয়ত এতখানি ঘৃণা হত না। যদি বুঝতাম, শুধু নিচের তলার কিছু দুর্বত্ত এইসব অপরাধমূলক কাজকর্ম করে যাচ্ছে, তাহলেও এতখানি রাগ বা ঘৃণা হত না। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝেছি, নিচুতলার দুর্বৃত্তায়নের উৎস এবং অনুপ্রেরণা আসছে একেবারে উপর থেকে। এরা শোধরানোর নয়। বরং তৃতীয়বারের তৃণমূল আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।
এখনও সেই অবস্থান থেকে সরে আসছি না। গত এক বছরে এটা বারেবারে প্রমাণিত। কোথাও কোনও ভুল শুধরে নেওয়ার কোনও চেষ্টা নেই। বরং বেপরোয়া মনোভাব আরও বেড়েছে। তৃতীয়বারের তৃণমূল এটাই বুঝল, কেউ আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না। আমরা যা করছিলাম, সেটাই আরও বেশি করে করব। এবং সেটাই আরও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেবে। তৃতীয়বারের তৃণমূল আরও বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। ঔদ্ধত্য আরও চরমে উঠবে। জেলার প্রতি উপেক্ষা আরও তীব্র হবে। সময়ই এর উত্তর দেবে।
শেষবেলায় আরও একবার অকপট স্বীকারোক্তি। ভোটের হাওয়া বুঝতে সত্যিই ভুল হয়েছিল।