কুণাল দাশগুপ্ত
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধান করে না। মানুষ যখন বিকল্প চিন্তা ভাবনায় মন দেয়, জনপ্রিয়তাবাদের তত্ত্ব হাজির করেন পুঁজিপ্রেমীরা। দু’চারটে ভিক্ষার ঝুলি দিয়ে ক্ষোভ উপশম করে। অনেকটা হাঁটুর চোটে মলম লাগানোর মতো। গোটা বিশ্ব জুড়েই এর চল রয়েছে। এই দেশ, এই রাজ্যেও আছে।
এ রাজ্যের শিল্পচিত্র বিবর্ণ। কীভাবে এতে রঙ লাগানো যাবে তা আবার কারও জানা নেই। বেকারত্বের লেখচিত্র ওমিক্রনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভও। এবার কলকাতা পুরনির্বাচন এমনই একটা ইঙ্গিত দিয়ে গেল। মানুষের একটা অল্প অংশের কাছে ধরা পড়ে গেছে এই জনপ্রিয়তাবাদ। তাই ফিকে হয়ে যাওয়া বামেরা দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। কলকাতায় বিজেপি তেমন কল্কে পায়নি। যদিও মিডিয়া তার ম্যারাথন খেলা থেকে সরে আসেনি। রাজনীতিকে তৃণমূল–বিজেপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে।
বারবার বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, বিজেপি দ্বিতীয়। কারণ, বিজেপি ৩, বাম ২। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বামেরা ৬৬ জায়গায় দ্বিতীয়। বিজেপি সেখানে মাত্র আটচল্লিশ।
বামেদের ফল আরও ভাল হতে পারত যদি নির্বাচনে গণতন্ত্র থাকত। বিরোধীদের দলাইমলাই না করে, ছাপ্পার জয়গান না গেয়ে ভোট হলে বামেরা বেশ কয়েকটা বাড়তি আসন পেতেই পারত। আরও কয়েকটা জায়গায় হয়ত দ্বিতীয় হত।
মানুষ গত কয়েক বছর ধরে দেখেছে বিজেপি আর তৃণমূল নেতারা লাফ দিয়ে একবার টেনিস কোর্টের ওদিকে গিয়েছেন, কিছু দিনে পরেই আবার ঝাঁপিয়ে এদিকে এসেছেন। বামদলগুলো থেকে বেরিয়ে তো যাওয়া যায়, কিন্তু মনের খেয়ালে ফেরত আসা যায় না। আসনশূন্য দলগুলো এখনও নীতিশূন্য হয়নি।
মানুষ দেখেছে, করোনাকালে বামকর্মীরা জীবন বিপন্ন করে অনের জীবনের জন্য লড়েছেন। এবার প্রায় চল্লিশটা আসনে তরুণ রেড ভলান্টিয়ার্সরা প্রার্থী ছিলেন। তাঁদের যে একটা অংশের মানুষ সমর্থন করবেন এটা জানাই ছিল।
ঘটনা হল, মানুষ বামেদের মধ্যে নতুন মুখ দেখতে চেয়েছে। নেতৃত্বও সেই দাবিকে মর্যাদা দিয়ে তরুণ মুখে আস্থা রেখেছেন। আগামী দিনে চাকরি–বাকরি না পাওয়া বেকারদের ক্ষোভ বাড়বে। বাংলার মাটির তাপ বাড়বে। সেখানে এই ঝকঝকে তরুণদের আরও বেশি করে দেখতে চাইবে রাজ্য। এতে এই মুহূর্তে সব পাল্টে হয়ত যাবে না। তাতে হতাশার কিছু নেই। সিঁড়ির শেষধাপে পৌঁছতে গেলে তার আগের ধাপের দখল নিতে হয়। বাঙালি কিন্তু ধর্ম গেলা পছন্দ করে না। এটা প্রমাণিত। অতএব আবার একটা ফাঁকা জমি তৈরি হয়েছে বামপন্থীনের জন্য। সেখানে তাঁরা তাসের ঘর গড়বেন না ইমারত, তা বাম নেতৃত্বই ঠিক করবেন।
বামপন্থীদের একটা সমস্যা, বৃহত্তর বামের বদলে তাঁরা কংগ্রেসের গা ঘেঁষে থেকে ক্ষমতার উত্তাপের ভাগ পেতে চান। এতে কং বা বাম কারও লাভ হয় না। নেপোয়ে দই মারে। তৃণমূল–বিজেপির ভোটবাক্স সমৃদ্ধ হয়। ফেসবুকে কোনও কোনও অতি বিপ্লবীর পোস্ট পড়লে মনে হয়, শরিকদের ছেঁটে ফেললেই বোধ হয় সিপিএম জিতে যাবে। আসলে, তাঁরা জেলার বাস্তবতাই বোঝেন না। বাম আন্দোলনের ইতিহাসটাও জানেন না। আগে মাঝেই আওয়াজ তোলা হত, ক্ষমতা থেকে সরে গেলেই শরিকরা বামফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাবে। দশটা বছর পেরিয়ে গেছে। কোনও শরিক কিন্তু ছেড়ে যায়নি। ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করে তাঁরাও কিন্তু একই ছাতার তলায় আছেন। তাৎক্ষণিক লাভের আশায় বা মন্ত্রীত্বের আশায় অনেকেই যেতে পারতেন। শরিকদের থেকে যেমন কেউ কেউ গেছেন, বড় শরিক সিপিএম থেকে যাওয়ার সংখ্যাটাও কিন্তু কম নয়। কাজেই এক্ষেত্রে শুধু শরিকদের দায়ী করাটা যুক্তির নিরিখে ঠিক হবে না।
বামফ্রন্টের বাইরে বামদলগুলির মধ্যে সিপিআইএম-এল (লিবারেশন) আর এসইউসিআই-এর অবস্থান খুব একটা পরিষ্কার নয়। এরা বিহার, অসমে সিপিআইএম-এর সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে কিন্তু এই রাজ্যে নয়। এর ফলেও ধাক্কা খেতে হচ্ছে বাম আন্দোলনকে। বামদলগুলোর মধ্যে এই ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি’ মানসিকতার অবিলম্বে বদল প্রয়োজন।