রাহুল রায়
তখনও মাষ্টারমশাই, স্যার হয়ে ওঠেননি। কিংবা দিদিমণি হয়ে ওঠেননি ম্যাডাম। স্মৃতিটা তখনকার। পুরানো হলেও কিন্তু অমলিন। বাবা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পড়েছি ওই স্কুলে দুই বছর। মাষ্টারমশাইয়ের ছেলে বলে আদরও একটু বেশি ছিল, সঙ্গে শাসনটাও। খেলার ছলে একবার রাজদূত বাইকের আগে আঙুল দেখিয়েছিলাম বলে সটান চড় প্রভাতবাবুর কাছে। তাই হয়তো লজেন্সটা প্রাপ্য ছিল।
তখন স্কুলে স্কুলে আয়রন ট্যাবলেট আর ইঞ্জেকশান দিতে আসত মনে পড়ে নিশ্চয়। তো একবার নার্সই ভুল করে ইঞ্জেকশান দিয়ে দেয়। এয়ার থেকে যায়। আর একবার স্কুলেরই কোনও কাজে সাইকেল নিয়ে অন্য আর এক স্কুলে বাবা গিয়েছিল, শনিবারের দিন। বাবা আর ফেরে না। দিদিমণি, মাষ্টারমশাইরা রীতিমতো চিন্তিত। দিদিমণি তো আমাকে বললেন, ‘বাড়ি যাবি কী করে, বাবা তো আসছে না, কী করবি?’ কী জানি কী মনে হল, প্রভাতবাবু বললেন, চলো দেখি একটু এগিয়ে, এত দেরি হওয়ার তো কথা নয়। স্কুল থেকে অদূরে বাবা নারকেল গাছের তলায় মাথা ঘুরে পড়ে আছেন। সত্যি সাংঘাতিক ব্যাপার। মাষ্টারমশাই দিদিমণিরা তো ধরাধরি করে নিয়ে এসে চোখেমুখে জল দিয়ে জ্ঞান ফেরালেন। ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসে গয় (ঠিকই পড়ছেন) দা। বাবার প্রেসারের সমস্যা ছিল। সহকর্মীর প্রতি ভালবাসা আর দায়িত্ববোধটা এই বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শিখিয়েছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাতবাবু। আমার প্রথম প্রাথমিক স্কুলের নাম ‘বড়বাড়ি শ্রীকৃষ্ণ বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
প্রাথমিক আর উচ্চবিদ্যালয় একদম পাশাপাশি হওয়ার জন্য খেলার জায়গাটা এক। আর গয়দা একটা উচু ঢিপির মতো জায়গায় বসে বেচতো—— মর্টন চকোলেট, আনারস চকোলেট, মদনকটকটি, পপিনস। কাঠিআচার, এস বিস্কুট, পটল বিস্কুট (পটলের মতো দেখতে আর ঝাল ঝাল), লম্বু, বাপুজি কেক, মশলামুড়ি। মনে পড়ে গেল তো স্কুলের দোকানের কথা। তখনও দশ পয়সা পাচ পয়সা চলছে রমরমিয়ে ঝমঝমিয়ে আর সগৌরবে।
যে কটা নাম আজও মনে পড়ে – প্রদীপ, শমু, আফজল আর আমিনা। আমাদের গ্রামের দিকে হাটবারের চল ছিল। নাজিরবাজারের উপর দিয়ে আসতাম। যখন হাট লাগত নাজিরবাজারে। স্বাভাবিকভাবে বাড়ি ফিরতে হত অনেকটা দেরি। বাবা বেশ বাঙালি মেজাজে বসতেন বন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে। চলতো পার্টি পলিটিক্স আর দেশকাল। চা-সিঙ্গাড়া চপ বিস্কুট তো আছেই। আমি এক ঠোঙা মশলা মুড়ি আর চপ নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আর বেড়িয়ে আসতাম হাটে।
আরে ওই তো চামড়া বিক্রির দোকানটা। আরে এই তো লক্ষ্মীখুঁটির দোকানটা। সারি সারি ভাবে বসত সব্জি , টেলারিং, ছাতা সারাবার, ল্যাম্প, বড়শির উপকরণ, চপ–সিঙ্গাড়া, খেজুরগুড়–পাটালি, কাচের চুড়ি, গামছা লুঙ্গি, তাঁতের শাড়ি, মাটির হাড়ি, সব্জি বীজ, শীল-নোড়া, হাওয়াই, মাদুর–চাটি, ঝালমুড়ি, ধূপকাঠির দোকানগুলো। কেনার থেকে দোকানদারদের সঙ্গে সখ্যতা ছিল বেশি। বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম হাট টা কে। ‘কী, কাকু কেমন আছো’ কিংবা ‘আগের হাটবারে তুমি তো আসোনি– একটা হাটুর বয়সি ছোটো ছেলে আর বাবা/ দাদুর বয়সি একজন দোকানদারের কথপোকথনে ছিল নির্মল এক ভালবাসা। হারিয়ে যাবার ভয় ছিল না ওই টুকু বয়সে। সবই চেনা মুখ আর জানতাম বাবা কোথায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর একটা কারণ ছিল ভয় না পাওয়ার। আমার বাবাদের ব্যাচ ছিল নাজিরবাজার হাইস্কুলের প্রথম ব্যাচ আর বাবা স্কলারশিপও পেয়েছিলেন। তারপর ছিলেন স্কুল অন্ত প্রাণ। তো ভয় ছিল না।
গ্রামবাংলার এই গ্রাম্য জীবনে এই হাটবারগুলো ছিল মিলনমেলার মতো।
বাড়ির থেকে স্কুল অনেক দূর হওয়ার কারণে ভর্তি হতে হয় বাড়ির পাশের স্কুলে। তাতে কোনওদিন অসুবিধে হয়নি। গ্রামের ব্যাপার তো। সবই চেনা মুখ। তো নামগুলো বলি বন্ধু– বান্ধবী দের। শম্ভু, পেলকা, সন্দীপ, সোমনাথ, মুকুন্দ, মনোজ, সুদীপ, রণিত, সুষমা, মহুয়া, মৌসুমি, পারমিতা, মান্তুশি, মোনালিসা, সুতৃষ্ণা, বর্ণালী, রেস্মিতা, শ্রাবণী। আর মাষ্টারমশাইদের নাম –অমরবাবু, নতুন মাষ্টারমশাই (অর্দ্ধেন্দুবাবু), চিত্তবাবু আর প্রতিভা দিদিমণি। সব একসঙ্গে বসতাম। বন্ধুত্বটাও যেমন ছিল প্রাণেপ্রাণে আর মারপিটটাও ছিল ঠ্যাঙাঠেঙি। আবার কেঁদে গলা ধরে ভাব করাটাও ছিল অকৃত্রিম।
বাড়ির পাশাপাশি হওয়ার কারণে বাড়ির থেকে মুড়ি চানাচুর খেয়ে স্কুল আর টিফিন টাইমে বাড়ি গিয়ে ভাত। আমাদের টিফিন টাইম অনেক সময় ধরে হত কিনা। এতো চাপ ছিল না পড়াশোনো করার। পাঁচ পাঁচ ওভারের ম্যাচ হয়ে যেত দু’তিনটা। টিফিন টাইমে খেলাগুলোও ছিল দারুণ। ব্যাটবল, লুকলুকানি (ওই যে সব্বাই লুকোবে আর একজন সব্বাইকে খুঁজে বের করবে) ডাংগুলি।
আবার স্কুল থেকে ফিরে এসে দুটি মুখে গুঁজে দৌড় মাঠের দিকে। খেলা হত বউবাসন্তি, এলন্ঠি লন্ঠন, গদি, খো খো, আব্দুল। গ্রামীণ জীবন না কাটালে পরে এই খেলাগুলোর নাম নতুন কিংবা অঞ্চল হিসাবে আলাদা হতে পারে। এটা প্রাত্যহিক ব্যাপার ছিল।
আবার স্কুলে স্কুলে চাল দেওয়া হত। সে আর এক মজাদার ব্যাপার। ‘ও কাকু আমাকে এক ডিবা চাল বেশি দাও’ কিংবা ‘ওকে বেশি দিলে আমাকে কেন কম’ এই কথাগুলোর মধ্যে একটা শিশুসুলভ সরলতা ছিল। ওই চাল তো দিত, কিন্তু বাড়ি পৌঁছত কিঞ্চিত। কাচা চাল খেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খালের মাছকে খাইয়ে ব্যাগে থাকতো সামান্য।
আবার স্কুলে সব পাশাপাশি বসতাম। বেঞ্চের অধিকার সবার সমান ছিল। মারপিটটা ও ছিল শিশুসুলভ। ‘তুই কেন আমার ব্যাগ থেকে তেঁতুল বের করবি’ কিংবা ‘তুই কেন আমার বাক্সের উপর বসবি’। ছোটো ব্যাগের পাশাপাশি অ্যালুমিনিয়ামের ছোট স্কুল বাক্সও ছিল। তারপর মাস্টারমশাই আসতেন। শাস্তিগুলো ছিল মজাদার। দুজন দুজনের কান ধরে দশবার উঠবোস।
আবার আমরা স্কুলে আচার বানাতাম। তৈরি হত আম বা আমড়ার আচার। আমরা আম কিংবা আমড়া, লঙ্কা তেল নুন নিয়ে আসতাম। আর মেয়েরা নিয়ে আসত মশলা জিরেগুড়া আম কটার জন্য ব্লেড বা বটি আর চেঁছার জন্য নিয়ে আসত বালির স্তুপ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসা পাথর। স্কুল শুরুর আগে সবকিছু তৈরি করে স্কুলের টালির চালে রোদে দিয়ে দেওয়া হত। টিফিন টাইমে সব্বাই একসঙ্গে বসে আচার খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। মাস্টারমশাই আর দিদিমণিদেরদের ও দিতাম।
আবার কোনও কোনও সময় মশলা মুড়ি। এমন ও দিন গেছে যে চানাচুর নিয়ে আসা হয়নি। দিদিমণির কাছ থেকে দশটাকা নিয়ে দে ছুট দোকানে। দশ টাকার চানাচুর মানে অনেক। মাষ্টারমশাই দিদিমণিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল বাড়ির বাবা–মায়ের মতো।
আমরা এখনকার ছেলেদের মতো প্রেজেন্ট স্যার বলতাম না। ‘রোল নাম্বার এক’ –‘উপস্থিত মাট্টারমচাই (শৈশব তো)।
কে জানে সেই হাজিরা খাতাটা এখন আছে কিনা। খুব কেঁদেছিলাম প্রাইমারি স্কুল ছাড়ার সময়। ফোর থেকে যে ফাইভে উঠতে হবে। শৈশবের সোনামাখানো দিন যা আজও অমলিন। এ স্মৃতি আমার একার নয়, এ স্মৃতি তোমার–আমার সবার। যা গেছে চলে তা কি সত্যিই গেছে চলে? নাকি হাতছানি দিয়ে ডাকে?
***
স্মৃতিটুকু থাক
হারিয়ে যাওয়া দিন। এভাবেই উকি মারে। এভাবেই ফিরে ফিরে আসে। বেঙ্গল টাইমসের জনপ্রিয় বিভাগ, স্মৃতিটুকু থাক। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো এভাবেই উঠে আসুক। আপনিও লিখুন আপনার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা। আপনার ছেলেবেলার সঙ্গে আরও অনেকের ছেলেবেলাও জড়িয়ে আছে।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com