রক্তিম মিত্র
তাঁর কোনওকিছুই হঠাৎ করে নয়। তিনি যে বিজেপিতে যাচ্ছেন, অনেক আগে থেকেই সেই দেওয়াল লিখন পরিষ্কার ছিল। কখনও একটু বেসুরো কথা। কখনও ক্যাবিনেটে গরহাজির। কখনও জেলায় জেলায় হোর্ডিং। হতেই পারত দর বাড়ানোর চেষ্টা। কিন্তু তিনি তার থেকে একটু বেশিই এগিয়ে গিয়েছিলেন। যেখান থেকে ফিরে আসার রাস্তা ছিল না।
আবার তিনি যে তৃণমূলেই ফিরছেন, এটাও অনেক আগে থেকেই পরিষ্কার ছিল। ভোট পেরোতেই হিসেব কষে বেসুরো। দরজায় কড়া নেড়েই চলেছিলেন। কখনও ফেসবুক পোস্টে, কখনও বিজেপি–র থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে, কখনও এর–ওর বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাতে। শুধু দরজাটা খোলার অপেক্ষা ছিল।
তবে তিনি যথার্থই বড় মাপের নেতা। কারণ, তাঁর দুটোই হল রাজ্যের বাইরে। বিজেপিতে যোগদান করলেন বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটে দিল্লিতে উড়ে গিয়ে। তৃণমূলে ফিরে আসাটার সঙ্গেও বিমান–যোগ জড়িয়ে আছে। উড়ে গেলেন আগরতলায়। সেখানে ধরলেন দলের পতাকা। অনেকেই দিল্লিতে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘরওয়াপসিটা হয়েছে ঘরের মাটিতেই। সেদিক থেকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় একপ্রকার নজিরই গড়লেন। এই রাজ্যে আর কোনও নেতার সম্ভবত এই ‘কৃতিত্ব’ নেই।
অনেকে বলতে পারেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে এত কুকথা বলার পরেও সেই তৃণমূলেই ফিরলেন। কিন্তু সত্যিই কি রাজীব সেই মানের কু কথার আশ্রয় নিয়েছেন? খুব বেশি পুরনো ঘটনা তো নয়। একটু স্মৃতি হাঁতড়ালেই পাওয়া যাবে। দল ছেড়ে গেলে, অন্য শিবিরের হয়ে ভোটে দাঁড়ালে যেটুকু না বললেই নয়, সেটুকুই বলেছেন। এবং সেটাও আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষার জন্য। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে তেমন কোনও মারাত্মক অভিযোগ আনেননি। যে ভাষায় শুভেন্দু বা অন্যরা আক্রমণ করেছেন, শিক্ষিত–মার্জিত রাজীব কখনই সেই রাস্তায় হাঁটেননি। কোথাও একটা মাত্রাজ্ঞান ছিল। বিজেপির যে প্রচার, সেই প্রচারেও সেভাবে গলা মেলাতে দেখা যায়নি। বেগম বলা বা হিন্দু মুসলিম তাস খেলা— এসব থেকে যতটা সম্ভব দূরেই থেকেছেন। বাকিদের মতো বিধায়ক পদ ধরে রেখে দলবদল করেননি। শুভেন্দু এবং তিনি আগে মন্ত্রীসভা থেকে, পরে বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করে তবে অন্য দলের পতাকা হাতে তুলেছিলেন। তাই অন্যদের থেকে তাঁর দলবদল একটু হলেও আলাদা।
মানতেই হবে, রাজীব ব্যানার্জি একজন অত্যন্ত সফল মন্ত্রী। খুব কম মন্ত্রী নিজের দপ্তরের কাজটা বোঝেন। রাজীব যখন যে দপ্তরের দায়িত্ব নিয়েছেন, দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। সেচ দপ্তরের দায়িত্ব নিয়ে সীমিত ক্ষমতায় যেটুকু করা সম্ভব, তার অনেকটাই করেছেন। যাঁরা দপ্তরের খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, এই দপ্তরে অন্য একটা মাত্রা এনেছিলেন এই উদ্যমী মন্ত্রী। সেচ থেকে নির্বাসিত হয়ে কিছুদিন অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দপ্তরে। পরের দিকে বনদপ্তরে। এই দপ্তরে বিশেষ কিছু করার ছিল না। কিন্তু খুব দ্রুত দপ্তরের খুঁটিনাটি বুঝে নিয়েছিলেন। কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যেত, একজন লেখাপড়া জানা মানুষ কথা বলছেন। কথায় তথ্য থাকত, যুক্তি থাকত, মার্জিত আচরণ থাকত। দপ্তরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ও আগামীর রোড ম্যাপ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল। যেটা অধিকাংশ মন্ত্রীরই থাকে না। আরও একটু স্বাধীনতা পেলে হয়ত আরও ভালভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারতেন।
যাই হোক, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে নানা মহলে তাঁর নামে নানা বিদ্রুপ চলছে। হয়ত চলাটাই স্বাভাবিক। একজন যদি এক বছরের মধ্যে দু’বার ঠিকানা পাল্টান, সমালোচনা হবেই। কিন্তু একা রাজীবকে দায়ী করে কী লাভ? আপনি রাজীবকে ঘৃণা করেন নাকি এইরকম দলবদলের প্রবণতাকে ঘৃণা করেন, সেটা আগে ভেবে নিন।
আপনি এতদিন অমিত শাহকে চানক্য বলে এসেছেন। যিনি একেক রাজ্যে গিয়ে অন্য দলের বিধায়কদের ভাঙিয়ে এনে সরকার ফেলে দিচ্ছেন। আসাম থেকে গোয়া, মণিপুর, হরিয়ানা। যেখানে বিজেপির সরকার হওয়ারই কথা নয়। কিন্তু কেনাবেচার মন্ত্রে সরকার হয়ে গেল। কর্ণাটক থেকে মধ্যপ্রদেশ, সেখানেও বিধায়ক কেনাবেচা করে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে জোর করে মন্ত্রীসভা বানিয়েছেন। এগুলোও নাকি মাস্টারস্ট্রোক। এমন চেষ্টা রাজস্থানেও হয়েছে। এর পেছনে নীতি, নৈতিকতা বা আদর্শ তো ছেড়ে দিন। ন্যূনতম চক্ষুলজ্জা টুকুও নেই। তিনিই চার্টার্ড ফ্লাইট পাঠিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলেন রাজীব ব্যানার্জিদের। ভোটের আগে থেকেই জোর গুঞ্জন ছিল, বিজেপি যদি একশো কুড়িও পায়, তবু সরকার হয়ে যাবে। খোদ বিজেপি নেতারাই বলে বেড়াচ্ছিলেন। এই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিটা কী? অমিত শাহ নাকি বাকিদের কিনে নেবেন। তাহলেই বুঝে দেখুন, দলের নেতা–কর্মীরাই তাঁর সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করেন। তাহলে আর খামোখা রাজীবকে গালাগাল দিচ্ছেন কেন?
এবার মুদ্রার অন্য পিঠ। দল ভাঙানোর ব্যাপারে এই রাজ্যে যাদের কোনও জুড়ি নেই। একজনও সদস্য নেই। কিন্তু জেলা পরিষদ দখল হয়ে যায়। সত্যিই নজিরবিহীন সাফল্য। সারা দেশে এমন নজির আছে কিনা সন্দেহ। এত জিতেও খিদে মেটে না। ২১০ আসন পেয়েও অন্য দলের জেতা বিধায়কদের ভাঙিয়ে এনে কেউ কেউ বাহাদুরি দেখায়। যেন বিরাট এক কৃতিত্ব। এটা যে গৌরবের বিজ্ঞাপন নয়, এই বোধটুকুও নেই। খোদ বিধানসভায় দলবদলুর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে দলীয় পতাকা। কে তুলে দিচ্ছেন? একজন কলকাতার মহানাগরিক (এখন পোশাকি নাম পুর প্রশাসক)। আরেকজন পরিষদীয় মন্ত্রী। তাই সব্যসাচী দত্তকে গালাগাল দেওয়ার আগে এঁদের গালাগাল দিন। স্পিকার মশাই জেনেও কিছু করতে পারলেন! কারণ তিনিও জানেন কার নির্দেশে বিধানসভার আঙিনায় এই দলবদল হয়েছে।
একজন অন্য দলে যেতে চাইতেই পারেন। সেই দলে মোহভঙ্গ হলে পুরনো দলেও ফেরার ইচ্ছে হতেই পারে। কিন্তু এই দুটোর কোনওটাই তাঁর একক ইচ্ছেতে সম্ভব নয়। যারা হাট করে দরজা খুলে দিচ্ছেন, তাদের দায়টা অনেক বেশি।
আপনি একজনকে চানক্য বলবেন। আরেকজনকে উন্নয়নের কাণ্ডারি বলবেন। আর বেচারা রাজীব গালাগাল খাবেন! এটা কেমন বিচার! রাজীবকে যদি গালাগাল দিতে চান, তাহলে যারা সাংবিধানিক দায়িত্বে থেকেও এই নির্লজ্জ দলবদল করিয়ে যাচ্ছেন, যাঁরা সেই দলবদল করিয়ে বাহবা নিচ্ছেন, আগে তাঁদের ধিক্কার দিতে শিখুন। তাঁদের অপরাধটা অনেক বেশি। রাজীবদের অপরাধ সেই তুলনায় নেহাতই সামান্য।