দিব্যেন্দু দে
বছর তিনেক আগেও বাঙালি পিকে বলতে বুঝত প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নামটা বোধ হয় একটু ভারী হয়ে গেল। হয়ত অচেনা লোক মনে হচ্ছে। বেশ, নামটা একটু ক্রীড়ানুবাদ করে দেওয়া যাক। পিকে ব্যানার্জি। এবার নিশ্চয় চিনতে সমস্যা নেই। না চিনলে আপনার বাঙালি জন্ম বৃথা।
বছর ছয়েক আগে এই নামে আমির খানের একটা সিনেমা বেরিয়েছিল। ছবিটা বেশ হিটও হয়েছিল। সেই পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল বাংলার বিভিন্ন শহর। ছবিটা দেখার পর মনে হয়েছে, এই ছবিটার আর যাই হোক, পিকে নাম হওয়ার তেমন জোরালো কারণ ছিল না। এমন জোরালো কনটেন্ট, সেই তুলনায় নামটা একেবারেই বোকা বোকা।
বছর দুই আগে আবির্ভূত হলেন আরেক পিকে। অবশ্য, তখনও পিকে নামটা তেমন বহুল প্রচারিত ছিল না। লোকে তাঁকে প্রশান্ত কিশোর বলেই চিনত। কর্পোরেট দুনিয়া। তিনিও রাজনীতিতে কর্পোরেট ধ্যানধারণার পুরোহিত। তাই শর্ট ফর্মে ‘পিকে’ হতে সময় লাগল না। কী জানি, তিনি নিজেই হয়ত এই নামেই পরিচিত হতে চেয়েছিলেন।
এই লোকটিকে ঘিরে বড়ই রহস্য। তিনি কখন কোথায় আছেন, বোঝা মুশকিল। দু’বছর পর কোথায় থাকবেন, বোঝা আরও বেশি মুশকিল। কেউ বলেন, তিনি নিখুঁত হিসেব করে পা ফেলেন। উল্টো মতটাও আছে। কেউ কেউ বলেন, তিনি জানেন কখন ট্র্যাক চেঞ্জ করতে হয়। তাই চিত্রনাট্যে না থাকলেও দ্রুত নিজের ভূমিকা বদলে ফেলেন। তাৎক্ষণিক নতুন চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন।
একমাস আগেও গুঞ্জন উঠেছিল, তিনি নাকি কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কথাবার্তা একেবারে পাকা। তাঁকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা নিয়েও জোর চর্চা শুরু হয়ে গেল। তিনি একা নন। তিনি নাকি কানহাইয়া কুমারকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন। দেখা গেল, বামেদের তরুণ তুর্কি কানহাইয়া কংগ্রেসের পতাকা হাতে তুলে নিলেন। আর পিকে? ঠিক তার তিন–চার দিন আগে হঠাৎ করে ভবানীপুরের ভোটার হয়ে গেলেন।
বছর খানেক আগে হঠাৎ করে ইচ্ছে হয়েছিল বিহারের ভূমিপুত্র হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার। প্রথমে ঢুকে পড়লেন নীতীশ কুমারের দলে। একেবারে দলের সহ সভাপতি হয়ে। একইসঙ্গে সরকারি পোর্ট ফোলিও। মন্ত্রীরা তাঁর ভয়ে কম্পমান। হঠাৎ কী হল কে জানে, নীতীশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। ঠিক করলেন, নতুন দল করবেন। একেবারে যুবকদের নিয়ে। বিধানসভা বা লোকসভা ভিত্তিক দল নয়, একেবারে পঞ্চায়েত স্তর থেকে। অনেকদূর এগিয়ে গেলেন। বড় বড় স্বপ্ন দেখালেন। নিজেকে বারবার ‘বিহারি’ বলে জাহির করতে লাগলেন। দ্রুত সেখান থেকেও পাততাড়ি গোটালেন। এখন আবার তিনি বাংলার ভোটার। মাথায় কী ঘুরপাক খাচ্ছে, কে জানে!
গত দশ বছরে তাঁর জীবনের চাকা এভাবেই ঘুরপাক খেয়েছে। কখনও ইউনাইটেড নেশনসের চাকরি নিয়ে আফ্রিকায়। সেখানকার ইনিংসে ডিক্লেয়ার দিয়ে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির ভোট উপদেষ্টা। তারপর ২০১৪–র নির্বাচনের আগে মোদির ভোট কৌশলী। একটু একটু করে লাইম লাইটে আসতেই সেই সম্পর্কে মুলতুবি। সেখান থেকে বিহারে নীতীশ কুমারের উপদেষ্টা। একসময় যাঁদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই নীতীশ ও লালুকে আনলেন এক ছাতার তলায়। সেই জোটে কংগ্রেসও ছিল। সেই জোট এল বিহারের ক্ষমতায়। তারপর নীতীশ হঠাৎ করে লালুর সঙ্গ ছেড়ে বিজেপির শরিক। এখানেও তাঁর পরামর্শ ছিল কিনা, বলা মুশকিল। এরই ফাঁকে কখনও পাঞ্জাবে ছুটে গেছেন অমরিন্দর সিংকে জেতাতে। কখনও কেজরিওয়ালকে দিল্লিতে জেতাতে। কখনও উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের হয়ে খাটছেন। কখনও তো অন্ধ্রপ্রদেশে যাচ্ছেন জগনকে জেতাতে। কোথাও সাফল্য এসেছে। কোথাও আসেনি।
তবে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পশ্চিমবঙ্গে। লোকসভা ভোটে ধাক্কার পর জনমত তখন একেবারেই উল্টোস্রোতে বইছে। ৪২ এসেছিল ২২। আপাতভাবে অঙ্কের হিসেবে খুব খারাপ বলা যাবে না। কিন্তু তার কয়েকমাস পর যদি আবার ভোট হত, সেই ২২ টাও হয়ত ১৫–১৬ তে নেমে যেত। বিজেপি নেতাকর্মীদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা বোধ হয় সরকার গড়েই ফেলেছেন। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর ডাক পড়ল। এমন একটা আবহ, আজ এই নেতা বিজেপিতে যেতে চাইছেন, কাল ওই নেতা। প্রায় কাউকেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যাচ্ছে না। শতাধিক বিধায়ক বিজেপি–তে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আছেন, এমন জোরালো জল্পনা তৈরি হল। এবং সেই আশঙ্কা একেবারে অমূলকও ছিল না। সত্যিই যদি মুকুল রায়কে দল ভাঙানো ছাড়পত্র দেওয়া হত, তাহলে ভাঙনটা প্রায় এই স্তরেই পৌঁছত। হাওয়া প্রতিকূল বুঝে নিজের আসন বাঁচাতে আরও অনেকেই পদ্মশিবিরে ঝাঁপাতেন।
সেই সময় দলটা টিকিয়ে রাখাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক সেটাই করেছেন পিকে। যাকে যেভাবে বোঝানো যায়। যার সামনে যে টোপ ঝোলানো যায়। সেইসঙ্গে অন্য দল ভাঙিয়ে আনা। আপাতভাবে তার কোনও দরকার ছিল না। কাজটা নিঃসন্দেহে অনৈতিক। কিন্তু পিকে আসলে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, অন্য দল থেকে লোকেরা আসতে চাইছে। তার মানে সরকার পড়ছে না। তাঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে এরকম একটা বাতাবরণ তৈরি করা হয়ত জরুরি ছিল। ‘বিশেষ একজন’ সম্পর্কে যেভাবে সর্বস্তরে ক্ষোভ বাড়ছিল, সেই পরিস্থিতিতে তাঁকে কিছুটা আড়াল করাও জরুরি ছিল। হাওয়া বুঝে ঠিক সেটাই করেছিলেন। ‘দিদিকে বলো’ তে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক কতটা নিবিড় হয়েছে, বলা মুশকিল। তবে নিচুতলার নেতাদের মনে একটা ভয় ঢোকানো গেছে। আমি তোলা চাইলে, কেউ হয়ত নালিশ করে দেবে। আমি দুর্ব্যবহার করলে ঠিক জায়গায় নালিশ চলে যাবে। তখন টিকিট পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। আমি ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে যাব। ঠেলায় পড়ে কেউ কেউ ‘সুবোধ বালক’ হয়ে গেছেন। ভালর ভানটাও ভাল। তখন নিচুতলায় এই ভয়ের আবহ তৈরি না করা গেলে নিয়ন্ত্রণ রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়াত। কেউ কেউ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতেন।
প্রার্থী নির্বাচনেও বেশ মুন্সিয়ানার ছাপ। অনেককে বসিয়ে দেওয়া হল। অনেকের কেন্দ্র বদল হল। কাউকে আবার বসানো হলেও অন্য টোপ ঝুলিয়ে দেওয়া হল। আবার কেউ একটু ‘বেসুরো’ গাইলে সাধ্যমতো আটকানোর চেষ্টাও হল। তাই যতটা ভাঙন হতে পারত, অনেকটাই আটকানো গেছে। নেতারা অনেককিছুই দাবি করেন। বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ বলতে হয়। আড়াইশো আসন জিতব বলতে হয়। কিন্তু সেসব কথার তেমন মূল্য থাকে না। কিন্তু সবথেকে বড় ঝুঁকিটা তিনিই নিয়েছিলেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিজেপি একশোর ওপর আসন পেলে আমি এই পেশাই ছেড়ে দেব। বিজেপি একশোর নীচে আসন পাবে, এটা অতিবড় তৃণমূল সমর্থকও কি ভাবতে পেরেছিলেন? সরকার উল্টে যেতে পারে, অনেকের মধ্যেই এরকম একটা আশঙ্কা ছিল। ঘরোয়াভাবে অনেকেই সেই আশঙ্কা প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু একমাত্র পিকে–ই নিশ্চিত ছিলেন, তৃণমূল দুশোর ওপর আসন পেতে চলেছে। কীসের ভিত্তিতে? কীসের অঙ্কে? হাওয়া তো মোটেই এত অনুকূল ছিল না।
‘বাংলার গর্ব মমতা’ বিষয়টা যত না প্রশংসিত, তার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্রুপ হজম করতে হয়েছে। আই ভোটের আগে বাজারে ছাড়লেন, ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। সরকারকেও নামালেন। কখনও স্বাস্থ্যসাথী, দুয়ারে সরকার আবার কখনও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টোপ দিয়ে। কতটা কাজ হয়েছে, ভবিষ্যতে কতটা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু ভোটের আবহে এই সব প্রকল্পকে আলোচনার আবহে আনতে পেরেছেন, এদিকে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন, কিছুটা হলেও স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন, এটাই বা কম কী? সবমিলিয়ে ভোটের পাটিগণিতটা তিনি বোঝেন। যদি এতকিছুর পরেও তৃণমূলের ভরাডুবি হত! তাহলে পরিণতি কী হত, গত দু’বছর বাংলার হাওয়া গায়ে মেখে এটুকু হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন। কতরকম তকমা যে ধেয়ে আসত! কোথাও কোথাও হয়ত ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু কেউ বেইমান বা গদ্দার তকমা দেননি। কিন্তু বাংলায় হয়ত সেটাও জুটে যেত। এমন দুর্নাম রটত, আর কেউ তাঁকে ডাকতেন কিনা সন্দেহ। হয়ত সেই আঁচ করেই বলেছিলেন, তৃণমূল হারলে এই কাজটাই ছেড়ে দেব।
কিন্তু বিরাট ব্যবধানে জয়ের পরেও জানিয়ে দিলেন, আর তিনি এই কাজ করবেন না। তাহলে কি রাজনীতির নতুন ইনিংস শুরু করবেন? আগে বারবার জানিয়েছেন, আগামী দশ বছর আমি লোকসভা বা রাজ্যসভার সদস্য হব না। কিন্তু মাঝে মাঝেই গুঞ্জন ওঠে, তৃণমূল থেকে রাজ্যসভায় যেতে পারেন। ভোট স্ট্র্যাটেজিস্টের কাজ করবেন না বলেছেন ঠিকই, কিন্তু সহজে কি নিস্তার মিলবে? তৃণমূলের ত্রিপুরা অভিযানে আই প্যাকের বড় ভূমিকা আছে। এমনকী গোয়ায় কংগ্রেস শিবিরে ভাঙন ধরানোর মূলেও তিনি। তার মানে, ঢেঁকিকে সেই ধান ভানতেই হচ্ছে।
শুরুর দিক অনেকেরই সংশয় ছিল, মমতা ব্যানার্জি কি আদৌ পিকের কথা শুনবেন? মাঝে মাঝে বলে উঠতেই পারেন, ‘তুমি রাজনীতির কী বোঝো? তুমি একটা পঞ্চায়েত ভোটে জিততে পারবে? বড় বড় ডায়লগ দিও না। আমাকে রাজনীতি শেখাতে এসো না।’ সত্যিই এরকম বলেছেন বা বলবেন কিনা জানা নেই। বা, বললেও পিকে কীভাবে কথাগুলো নেবেন, বলা মুশকিল। হয়ত ঠাণ্ডা মাথায় হেঁসে উড়িয়ে দেবেন। হয়ত গায়েই মাখবেন না। এমন কত কথা তাঁকে শুনতে হয়েছে! এতদিনে নিশ্চয় গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী যে তাঁর কথা শুনেছেন, সেটা সিদ্ধান্তগুলো দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু এতকিছুর পরেও মমতার সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের এক ফ্রেমে ছবি প্রায় নেই বললেই চলে। গুগল ইমেজ তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এক–দুটো আবছা ছবির বেশি কিছু পাওয়া যাবে না। এত এত ঘরোয়া সভায় তিনিই বক্তা। অথচ, চ্যানেলে বা কাগজে সেইসব দৃশ্য দেখেছেন? এত লোকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কোনও ফেসবুক, টুইটার বা ইনস্টাগ্রামে সেসব ছবি সাঁটাতে যাননি। মোদ্দা কথা, প্রচার থেকে অনেকটাই দূরে। জাতীয় চ্যানেলে কয়েকবার হয়ত মুখোমুখি ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে। কিন্তু বাংলা চ্যানেলে ইন্টারভিউ তো দূরের কথা, টিভি চ্যানেলের বুমের সামনে দু–এক লাইনের প্রতিক্রিয়াও দিয়েছেন বলে মনে হয় না। নিজেকে আড়াল রাখা। এটাই তাঁর ইউএসপি। প্রচার সর্বস্বতার আবহে এই সংযম ধরে রাখা যার তার কম্ম নয়। আরও একটি বড় গুণ, একজনের কথা আরেকজনকে বলেন না। তাই অবলীলায় বলতে পারেন, নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধী–দুজনের দরজাই আমার কাছে সবসময় খোলা। যে কোনও সময় যার সঙ্গে খুশি দেখা করতে পারি। তালিকাটা বাড়তে বাড়তে কতগুলো রাজ্যে, কতগুলো দলে পৌঁছবে, বলা মুশকিল। পাঁচ বছর পর তিনি কোন ভূমিকায়? নিজেই হয়ত জানেন না। পথই হয়ত তাঁকে নতুন পথ বলে দেবে।
(বেঙ্গল টাইমসের শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত)