রক্তিম মিত্র
ঠিক এক সপ্তাহ আগের কথা। ছোট ভাই অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর কী অসাধারণ একটা লেখা লিখলেন দাদা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা, মফস্বলের ভাইয়েরা। কী ঝরঝরে গদ্য। কী অপূর্ব প্রকাশভঙ্গি, কী অসাধারণ সংযম। রাজ্যের মানুষ সেদিন যেন অন্য এক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনেছিলেন।
তিনি মাধ্যমিকের কৃতী, একসময়ের কৃতী সাংবাদিক, দুরন্ত লেখক–এই পরিচিতিগুলো সর্বসাধারনের তেমন জানা ছিল না। যেমন জানা ছিল না তিনি অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা। যেমন জানা ছিল না মফস্বল থেকে উঠে এসে শহরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই। না, নিজের লেখায় এসব কোনওকিছুই তিনি ঢাক পেটানোর মতো করে বলেননি। নিজেকে আগাগোড়া রেখেছেন সংযমের ঘেরাটোপে।
এমন আমলা যে কোনও প্রশাসনের সম্পদ। কিন্তু তিনিও হয়ে উঠছেন রাজনীতির বড়ে। আমলাতন্ত্রের নিয়ম, প্রোটোকল সবই তিনি জানেন। জ্ঞানত অমান্য করেন না। কিন্তু পাশাপাশি আমলাতন্ত্রের সীমাবদ্ধতাও বোঝেন। ইতিহাস থেকেও বোঝেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেও বোঝেন। শাসকের ইচ্ছেতেই তাঁকে চলতে হয়। সেই শাসকের যদি প্রশাসন সম্পর্কে কোনও ধ্যানধারণা না থাকে, তবুও তাঁর মন জুগিয়েই চলতে হয়। তালে তাল দিয়ে যেতে হয়। সেই শাসকের ভুলভাল ইচ্ছের রূপায়ণ করতে হয়।
রাজ্যপালের মনে হয়েছে, এই আমলারা মুখ্যমন্ত্রীর কথায় চলছেন। একটু নালিশ জানানো দরকার। প্রধানমন্ত্রীরও হয়ত মনে হয়েছে, ঝিকে মেরে বউকে একটু শিক্ষা দেওয়া যাক। এই আমলাকে দিল্লিতে টেনে নেওয়া যাক। অন্তত মুখ্যমন্ত্রীকে শিক্ষা দেওয়া যাবে। হায়! এসব করতে গিয়ে তাঁরা জানেনও না যে আর দুদিন পরেই লোকটার অবসর নেওয়ার কথা। এই অবস্থায় রাজ্যকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে একজন মুখ্যসচিবকে দিল্লিতে বদলি করা চূড়ান্ত এক অসভ্যতা। আইনে সেই বিধান আছে কিনা, সেটা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। কিন্তু এটা যে সুস্থতার নজির নয়, এটা যে চরম অসভ্যতা, এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী ঝগড়া করার কিছু একটা ইস্যু পেলেই হল। যেটা অনায়াসে ফোনে বলা যেত, যেটা ঝগড়া না করেও সমাধান করা যেত, সেটাকে অহেতুক যুদ্ধং দেহি–র স্তরে নিয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী চিঠি লিখতেই পারেন। কিন্তু সেটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছনোর আগেই মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই চিঠি ফাঁস রাজ্যের তরফেই হয়েছে। এটাও সমান এক অসভ্যতা। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি ফাঁসটাও কম অপরাধ নয়। এবং মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেতেই সেটা ফাঁস হয়েছে, এটা বোঝার জন্যও বড় বোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই।
তারপর বিকেলের সেই লম্বা প্রেস কনফারেন্স তো আছেই। রোজ তাঁকে বকে যেতে হবে। টিভিতেও সেগুলো লাইভ দেখাতে হবে। নতুন নতুন ইস্যু চাই। পেয়ে গেলেন। আর সেটাকে নিয়ে অর্বাচীনের মতো বকে গেলেন। প্রশাসনিক জায়গা থেকে কোনটা বলতে হয়, কোনটা বলতে নেই, এই জ্ঞানটা তাঁর কোনওকালেই নেই। যথারীতি সেই ধারাবাহিকতাই বজায় রাখলেন।
মাঝখান থেকে স্যান্ডউইচ হয়ে গেলেন সুভদ্র, সুমার্জিত আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজেরা যত খুশি ঝগড়া করুন, খেউড় করুন। দোহাই এমন গুণী আমলাকে এভাবে স্যান্ডউইচ বানাবেন না।