সরল বিশ্বাস
প্রথমেই অকপটে বলে রাখি, এবার বিধানসভা নির্বাচনে আমার হিসেব একেবারেই মেলেনি। আর দশজনের মতো, আমিও ভেবেছিলাম, এবার রাজ্যে পরিবর্তন আসছে। বিজেপি দুশোর কাছাকাছি আসন পাবে। তৃণমূল হয়ত একশোর নিচে নেমে যাবে। শুধু ভেবেছিলাম বললে ভুল হবে। অনেকের কাছে নিজের এই মনোভাবের কথা জানিয়েও ছিলাম। এই হলে এই হবে, অমুক ভোট এত পার্সেন্ট সুইং হলে এই হতে পারে— এই জাতীয় ভাসা ভাসা মন্তব্য নয়। দুদিক খুলে রাখার চেষ্টাও নয়। সরাসরিই নিজের মত জানিয়েছিলাম। তাই পরে অন্যরা যতই ডিগবাজি মারুক, আমি অন্তত সেই ডিগবাজি মারতে পারব না। এত লোককে নিজের মতামত জানিয়েছিলাম, পাল্টি খাওয়ার উপায়ও নেই।
কেন এমনটা মনে হয়েছিল? সত্যিই কি আমি বিজেপির সমর্থক? আমি কি অমিত শাহর কথায় (ইসবার দোশো পার) স্লোগানে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলাম? বিজেপির সংগঠন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে, এমনটা মনে করেছিলাম? বিজেপি এলে সুশাসন আসবে, এমনটা ভেবেছিলাম? এর কোনওটাই নয়। আমার ভোট প্রতিবারের মতো বামেই পড়েছে। চিরদিন তাই পড়বে। কিন্তু তলায় তলায় প্রবল তৃণমূল বিরোধী হাওয়া টের পাচ্ছিলাম। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সেই বলছে বিজেপি জিতবে। এমনকী ছাপ মারা তৃণমূল কর্মীরাও চুপি চুপি জানিয়েছেন, এবার পদ্মফুলে মেরেছি। এই হাওয়ায় কিছুটা হলেও প্রভাবিত হয়েছিলাম। কলকাতার মিডিয়া কী বলছে, বুথফেরত সমীক্ষা কী বলছে, তাকে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি। তবে, বাম ভোটের বড় একটা অংশ যে লোকসভার মতোই এই ভোটেও তলায় তলায় পদ্মশিবিরে গেছে, এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। এই সব কারণেই মনে হয়েছিল, তৃণমূল নিশ্চিতভাবেই হারছে। বিজেপির প্রতি কোনও দুর্বলতা বা সহানুভূতি ছিল না। তারা এলে ভাল সরকার চালাবে, এই বিশ্বাসটাও ছিল না। তারা জিতলেও এটাই বলতাম, হাওয়ায় জিতেছে। এর পেছনে আরএসএসের ভূমিকা বা সাংগঠনিক দক্ষতা খোঁজার চেষ্টাই করতাম না। কারণ, বিজেপির আঠারো আসন জেতার পেছনেও তাঁদের তেমন কোনও ভূমিকাই ছিল না। জাস্ট তৃণমূল বিরোধী হাওয়ার সুফল পেয়েছিল বিজেপি।
অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, যেভাবেই হোক, বিজেপিকে আটকাতে হবে। এই অবস্থায় বামেদের ভোট দেওয়া মানে ভোট নষ্ট করা। বিজেপিকে আটকাতে তৃণমলে ভোট দিতে হবে। এই তত্ত্বেও ভরসা ছিল না। আমার অবস্থান ছিল খুব পরিষ্কার, আমার ভোট বামেই যাবে। তাতে বাম যদি সাত পারসেন্ট থেকে নেমে পাঁচ পার্সেন্টেও এসে যায়, তবু তার মধ্যে একটা ভোট আমার থাকুক। মনে হয়েছিল, বিজেপিকে আটকানোর ক্ষমতা হয়ত আমার নেই। কিন্তু এই কঠিন সময়েও নিজের ভাল লাগাকেই আঁকড়ে থাকতে চাই। বিজেপি বিপজ্জনক বলে তৃণমূলের একের পর এক ক্ষমার চোখে দেখতে হবে, এতখানি উদারতা আমার মধ্যে ছিল না। এখনও নেই। যদি বুঝতাম, তৃণমূল নিজেকে শুধরে নিতে পারে, তাহলে হয়ত এতখানি ঘৃণা হত না। যদি বুঝতাম, শুধু নিচের তলার কিছু দুর্বত্ত এইসব অপরাধমূলক কাজকর্ম করে যাচ্ছে, তাহলেও এতখানি রাগ বা ঘৃণা হত না। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝেছি, নিচুতলার দুর্বৃত্তায়নের উৎস এবং অনুপ্রেরণা আসছে একেবারে উপর থেকে। এরা শোধরানোর নয়। বরং তৃতীয়বারের তৃণমূল আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।
এখনও সেই অবস্থান থেকে সরে আসছি না। তৃতীয়বারের তৃণমূল এটাই বুঝল, কেউ আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না। আমরা যা করছিলাম, সেটাই আরও বেশি করে করব। এবং সেটাই আরও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেবে। তৃতীয়বারের তৃণমূল আরও বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। ঔদ্ধত্য আরও চরমে উঠবে। জেলার প্রতি উপেক্ষা আরও তীব্র হবে। সময়ই এর উত্তর দেবে।