নরেন মুদির মন কী বাত

বারবার বাংলায় আসছেন। প্রায় ডেইলি প্যাসেঞ্জার হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী। এত এত ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু মনে মনে ঠিক কী চাইছেন নরেন্দ্র মোদি? যদি সত্যিই এই নিয়ে মন কী বাত বলতেন, তাহলে কোন গোপন কথা উঠে আসত। জেনে নিলেন স্বরূপ গোস্বামী। 

এবারের মন কী বাত শুনলে আপনারা হয়ত চমকে যাবেন। এতদিন যেগুলো বলে এসেছি, বেশিরভাগই বানানো কথা। কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই মন কী বাত। মানে, আমি মনে মনে যেটা বলছি, সেটাই আপনাদের বলতে চাই।

ধোঁয়াশা বাড়িয়ে লাভ নেই। সোজাসুজিই বলা যাক, আমি চাই, বাংলায় এবারও তৃণমূলের সরকার থাকুক। আপনার নিশ্চয় অবাক হয়ে যাচ্ছেন। ভাবছেন, এতবার বাংলায় আসছি, এত কড়া কড়া কথা শোনাচ্ছি। আর আমি কিনা চাইছি বাংলায় তৃণমূল থাকুক। নিশ্চয় বিশ্বাস হচ্ছে না!‌

modi1

তাহলে, একটু খুলেই বলা যাক। ভারতের অধিকাংশ বড় রাজ্যেই আমাদের সরকার আছে। বাংলায় হল কী হল না, তাতে আমার কী যায় আসে বলুন তো!‌ কী হবে ?‌ বড়জোর মমতা ব্যানার্জি আমার নামে লাগাতার গালি দিয়ে যাবেন। কু কথা বলে যাবেন। যেহেতু তিনি মুখ্যমন্ত্রী, ফলাও করে সেসব মিডিয়ায় প্রচারও হবে। হোক, তাতে আমার বয়েই গেল। রাজনীতি যখন করতে নেমেছি, তখন এটুকু কুকথা হজম করতেই হয়। এটুকু সহ্যশক্তি আমার আছে।

বাম বন্ধুরা বলে বসবেন, সেটিং সেটিং। আমরা আগেই বলেছিলাম। না মশাই, ওসব সেটিং–‌ফেটিং কিচ্ছু নয়। আমি চলি আমার অঙ্কে। তাতে কারও সুবিধে হলে হবে। অন্যের সুবিধে অল্প, আমার সুবিধে অনেক বেশি।

দুভাগে ভাগ করে নেওয়া যাক। তৃণমূল আবার সরকারে না এলে আমার ক্ষতি কী কী ?‌ এবার উল্টোটাও ভাবুন, তৃণমূল সরকারে এলে আমার লাভ কী কী। তাহলেই হিসেবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ধরুন, তৃণমূল হেরে গেল। কী কী হতে পারে?‌ তৃণমূল দলটাই আস্তে আস্তে ভেঙে যাবে। কেউ কেউ চলে আসবে বিজেপিতে। কেউ কেউ চলে যাবে কংগ্রেসে। এমনকী, যে ২২ এমপি আছে, তাদেরও বড় একটা অংশ তৃণমূল ছেড়ে অন্য দলে ভিড়ে যাবেন। জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূল একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। তখন তামিলনাড়ুর স্ট্যালিন, দিল্লির কেজরিওয়াল, উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ, কর্নাটকের কুমারস্বামী, মহারাষ্ট্রের উদ্ধবরা কী করবেন?‌ তাঁদের সামনে কংগ্রেসের ছাতার তলায় যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। অন্য কেউ নেই যে তৃতীয় ফ্রন্টের হাওয়া তুলতে পারে। তৃণমূলের সুরও অনেক নরম হয়ে যাবে। তারাও তখন কংগ্রেসের জোটসঙ্গী হয়ে উঠবে। মৃতপ্রায় কংগ্রেস একসঙ্গে এত সঙ্গী পেয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। ভাজপা শিবির বনাম কংগ্রেস শিবির–‌এই হয়ে উঠবে লড়াইয়ের চেহারা। শাসক বিরোধী ভোট যদি এক জায়গায় গিয়ে পড়ে, তাহলে ক্ষতিটা কার?‌

এবার উল্টোটা ভাবুন। তৃণমূল আবার সরকারে এসে গেল। নিঃসন্দেহে বড় অক্সিজেন পাবে তৃণমূল। নানা লোকের গ্যাস খেয়ে দিদি তিন বছর পর দিল্লি দখলের জন্য ঝাঁপাবেন। আঞ্চলিক দলের আর কেউ নেই যিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন। অনেকেই দিদিকে বোঝাবেন, কংগ্রেসকে দিয়ে কিছু হবে না। আপনার নেতৃত্বেই সরকার হতে পারে। ছোট ছোট দলগুলি অনেকে প্রকাশ্যেই তাঁর হয়ে গলা ফাটাবে। একদিকে কংগ্রেস অন্যদিকে একঝাঁক আঞ্চলিক শক্তি। কিছুতেই সর্বাত্মক জোট হবে না। কংগ্রেসও দিদির নেতৃত্ব মানতে রাজি থাকবে না। দিদিও কংগ্রেসকে জমি ছাড়বেন না। মোদ্দা কথা, বিরোধী জোটকে ভন্ডুল করে দেওয়ার ক্ষেত্রে দিদির কোনও বিকল্প নেই। বিরোধী জোটে ফাটল ধরলে, বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে গেলে, কার সুবিধা?‌

এই সহজ অঙ্কটা আমি বুঝি। কিন্তু আমার রাজ্যের নেতারা কি বোঝে?‌ ওদের বোঝার দায়ও নেই। ওরা কুয়োর ব্যাঙ। বাংলার বাইরে কিছুই বোঝে না। কেউ স্বপ্ন দেখছে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার। কেউ স্বপ্ন দেখছে মন্ত্রী হওয়ার। দেখুক। স্বপ্ন দেখতে কে বারণ করেছে?‌ কিন্তু আমি জানি, ওদের কোনও মুরোদ নেই। না আছে সংগঠন। না আছে তেমন নেতৃত্ব। কিন্তু ওদের তো বলতে পারি না লড়াইটা ছেড়ে দাও। তখন ওরা বলবে, আমি আমার জন্য তৃণমূলকে ওয়াকওভার দিচ্ছি। ওরা অঙ্কটা বুঝে যাবে। তার থেকে একটু চড়া সুরে অভিনয় করা ঢের ভাল। ওদের বোঝাব, দেখো, আমি বাংলা দখল করতে কতটা মরিয়া। আসলে, যা যা করব, তাতে সুবিধা তৃণমূলেরই হবে।

যেমন, প্রথম পদক্ষেপ, তৃণমূলকে ভাঙো। ভাঙো মানে এমন লোকদের এনে টিকিট দাও, যাদের মানুষ ভোট দেবে না। তাদের ওপর রাগ করেই লোকসভায় লোকে আমাদের ভোট দিয়েছে। এখন তারাই যদি বিজেপির মুখ হয়ে ওঠে, মানুষ ভোট দেবে?‌ এতই সহজ?‌
ভোটের অঙ্কটা বোঝে মুকুল রায়। কিন্তু ওকে নিষ্ক্রিয় করা দরকার ছিল। প্রথমত শুভেন্দুকে এনে ওকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া গেছে। তারপর ওকে নদিয়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিজের প্রেস্টিজ রাখতে ওকে জিততেই হবে। ফলে, অন্যান্য জায়গায় নজর দিতে পারবে না। শুধু নিজের কেন্দ্রেই পড়ে থাকতে হবে।
টিকিট না পাওয়ায় দলের পুরনো লোকেরা এমনিতেই ক্ষুব্ধ। তাদের মন কী বাত আমি দিব্যি বুঝি। তারা মনে মনে বলছে, আমরা এতদিন দলটা করলাম, আর এখন বাইরে থেকে লোক এনে টিকিট দেওয়া হচ্ছে!‌ ফলে, তারাও বেঁকে বসেছে।
কে মুখ্যমন্ত্রী, ইচ্ছে করেই তা ঝুলিয়ে রাখলাম। লোকের মধ্যে ধোঁয়াশা বাড়ল। একদিকে মমতা, অন্যদিকে কে?‌ ভরসা আরও কমে গেল। এবার আমারও কিছু ভূমিকা আছে। এমন এমন আবোল তাবোল বকতে শুরু করলাম, যা প্রধানমন্ত্রীকে মানায় না। দিদির নামে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলাম, জানি বাংলার মানুষ এগুলো ভালভাবে নেবে না। চাইলে, সারদা, গরু, কয়লা, এসবের তদন্ত করাতেই পারতাম। ইচ্ছে করেই সিবিআইকে ঘুম পাড়িয়ে রাখলাম। ভোটের সময় হাওয়া গরম করতে চাইলাম। কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর ওপর মানুষের ভরসাই উড়ে গেল। অথচ, সিবিআইকে যদি একটু সক্রিয় হতে বলতাম, তৃণমূল দলটাই উঠে যেত। কিন্তু তা তো আমি করিনি। আমি সিবিআইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। ভাষণে হাওয়া গরম করেছি।

বারবার সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছি। এতে মুসলিম ভোট এককাট্টা হয়ে দিদির সঙ্গে জমা হয়েছে। তিরিশ পারসেন্ট যদি নিশ্চিত হয়ে যায়। সত্তরভাগ সংখ্যাগুরু ভোটারের মধ্যে শাসক দল পনের–‌কুড়ি শতাংশ ঠিকই পাবে। তাহলেই তো তাদের জেতা নিশ্চিত। এই সহজ অঙ্কটাই মেলাতে চেয়েছি। আমার দলের লোকেরা এতটাই গাধা যে তারা বুঝতেই পারল না।

তারা ভাবল, দিল্লি তাদের পাশে আছে। ভাবল, মোদি–‌অমিত শাহরা বাংলা দখল করতে মরিয়া। তারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। আমি তো এটাই চেয়েছি। মাঠে ছুটে বেড়াব, কিন্তু গোল করব না।

এবার বোঝা গেল, কেন আমি বারবার আসছি?‌ এবার বোঝা গেল, কেন আমি আবার তৃণমূলকেই চাই। চুপি চুপি মন কী বাত জানিয়ে রাখলাম। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমার জায়গায় আপনারা থাকলে আপনারা কী করতেন?‌ আমি যেটা করছি, সেটাই করতেন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.