সরল বিশ্বাস
বছর দুই আগের কথা। সেবার বাম–কং জোট হতে হতেও শেষমুহূর্তে ভেস্তে গিয়েছিল। একদিকে কংগ্রেসের যুক্তিহীন দাবি। অন্যদিকে, বামেদের অঙ্ক নির্ভরতা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে আলোচনা শুরু হয়েও থমকে গেল। ফল কী হল? তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে উঠে এল বিজেপি। বাম, কংগ্রেস দুই শিবিরই ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। কংগ্রেস পেল দুটি আসন। বামেরা খাতা খুলতেই পারল না।
এই আসন সংখ্যার নিরিখে কংগ্রেস নিজেদের অনেক বেশি শক্তিশালী ভাবতেই পারে। কিন্তু যে ৩৮ টি জায়গায় লড়াই হয়েছে, তার ফলাফল কী? লোকসভা ধরে ধরে একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। পাঁচটি জায়গায় কংগ্রেস এগিয়ে। বাকি ৩৩ জায়গায় বামেরা। বামেরা শুরু এগিয়েই নয়, অধিকাংশ আসনে কংগ্রেসের ভোটের চারগুন বা পাঁচগুন ভোট পেয়েছেন বাম প্রার্থী। কং প্রার্থীর ভোট যেখানে ১৭–১৮ হাজার, সেখানে বাম প্রার্থী হয়ত পেয়েছেন ৯০–৯৫ হাজার। কোথাও কং হয়ত ২০–২২ হাজার, সেখানে বামেরা ৮০–৮৫ হাজার। অধিকাংশ আসনে ছবিটা এরকমই। বামেদের ফল খুবই খারাপ, কিন্তু তারপরেও অধিকাংশ আসনে তারা কংগ্রেসের চার–পাঁচগুন।
কিন্তু এই হিসেবটা না বোঝেন কং নেতারা। না বোঝে মূলস্রোত মিডিয়া। তাই কংগ্রেস দেড়শো আসন দাবি করতে পারে। কেউ কেউ আবার একধাপ এগিয়ে অধীর চৌধুরিকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে ভোটে যাওয়ার দাবি তোলেন। এইসব লোকেরাও থাকছেন জোটের আলোচনায়। বামেদের বাধ্য হয়েই এইসব আজগুবি দাবি শুনতে হচ্ছে। কারণ, তাঁরা আন্তরিকভাবেই চাইছেন জোট হোক। যদি কিছু অন্যায় দাবি মেনে নিতে হয়, তাও জোট হোক।
যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিরোধী স্পেসটা অনেকটাই নিয়ে ফেলেছে বিজেপি। তৃণমূল বিরোধী ভোটের সিংহভাগই জমা হবে বিজেপির বাক্সে। এটাই বাস্তবতা। এখন জোট হলেও তার প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখা কঠিন। কিন্তু সেটা ভেবে তো হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। তাঁরা তাঁদের মতো করে চেষ্টা করছেন।
দুই শিবিরের মধ্যে বিরোধের জায়গা প্রচুর। কিন্তু এখন সেইসব প্রসঙ্গকে সামনে না এনে বরং ঐক্যমত্যের জায়গাগুলিতে জোর দেওয়া দরকার। যৌথ ইস্তেহারের নামে একগুচ্ছ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে সামনে না এনে যেগুলি বেশি গুরুতৃবপূর্ণ, সেইসব বাস্তবসম্মত দাবি তুলে ধরা হোক।
১) দুই দলই সিদ্ধান্তে আসুক, তৃণমূল থেকে আসা কাউকে প্রার্থী করা হবে না। পাঁচ বছর আগে তৃণমূল থেকে আসা অনেকেই কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছিলেন (এমনকী বাম তালিকাতেও এমন দু–একজন ছিলেন)। ফল কী হল? ভোটে জেতার পর তাঁদের প্রায় সবাই ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ শামিল হয়ে গেলেন। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া খুব জরুরি। দরকার হলে আনকোরা প্রার্থী থাকুক, কিন্তু তৃণমূল বা বিজেপিতে টিকিট না পাওয়া কাউকে যেন প্রার্থী না করা হয়।
২) জোর দেওয়া হোক শিল্পস্থাপন ও কর্মসংস্থানে। এবং তা যেন কলকাতা বা সংলগ্ন এলাকা কেন্দ্রিক না হয়। গিমিক নয়, অহেতুক প্রচার নয়, সত্যিকারের কাজ করতে হবে। যেটা সম্ভব নয়, স্পষ্টভাষায় জানাতে হবে।
৩) দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা হোক, সরকারটা হবে বাংলার, শুধু কলকাতার নয়। কলকাতা থেকে একঝাঁক মন্ত্রী নয়। গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পাবেন জেলার লোকেরাও। খরচের ব্যাপারে কলকাতা ও জেলার মধ্যে ভারসাম্য থাকবে। যাকে তাকে যে কোনও দপ্তরের দাযিত্ব নয়, যে দপ্তরে যিনি যোগ্য, তাঁকেই সেই দপ্তর দেওয়া হবে।
৪) এই সরকারের সবথেকে বেশি খরচ হয় হোর্ডিং আর বিজ্ঞাপনে। সাধারণ মানুষ তার খোঁজও রাখে না। গত দশ বছরে বিজ্ঞাপন বাবদ মোটামুটি কত খরচ হতে পারে, তার একটা হিসেব সংগ্রহ করা হোক। ঘোষণা হোক, আমরা এলে সরকারি টাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া হোর্ডিং থাকবে না। কাগজের প্রথম পাতায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া বিজ্ঞাপন থাকবে না। এখন যা ব্যয়, তার নব্বই ভাগ ছেঁটে ফেলা হবে।
৫) যদি কোনও জেতা প্রার্থী অন্য দলে চলে যান, তাহলে সেই প্রার্থীকে বেইমান, মিরজাফর–এসব বলার আগে নিজেরা হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হবে। কারণ, বিচক্ষণ নেতারাই তাঁকে প্রার্থী করেছিলেন। দলবদলের দায়টা নেতাদেরই নিতে হবে।
৬) আব্বাস সিদ্দিকিদের সঙ্গে কোনওরকম জোট নয়। বাম–কং নিজের শক্তিতেই লড়ুক। যে আব্বাস মিমের সহযোগী, তাদের সঙ্গে যতটা সম্ভব দূরত্ব রাখাটা খুব জরুরি। মিমের সঙ্গে জোট করবেন আর বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক বলবেন, দুটো একসঙ্গে হয় না। বরং এই খুচরো আপোসগুলোই বিজেপির হাতকে শক্তিশালী করে।