ড. অরিন্দম অধিকারী
২৪ শে জুন, ১৯৯০। বিশ্বকাপ ফুটবল। শেষ ষোলোর ম্যাচ চলছে। ব্রাজিলের অন্ধ সমর্থক। উৎকণ্ঠায় টেলিভিশনের পর্দায় চোখ আমার। গ্যালারিতে বসে থাকা ৬১৩৮১ জন দর্শকের সঙ্গে আমিও দেখছি একের পর এক ব্রাজিল আক্রমণ আর্জেণ্টিনার দুর্গে আছড়ে পড়ছে। কখনও পোস্টে তো কখনও সার্জিও গাইকোচিয়া দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গোলে স্কোরলাইন শূন্য থেকে এক হল না। খেলার একাশি মিনিটের মাথায় ঠিক ৪০ গজ দূর থেকে আলেমাও, দুঙ্গাকে পরাস্ত করতে করতে ক্রমশ ব্রাজিলের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে ওই বাঁ পায়ের ফুটবলারটি। তিনজন ডিফেন্ডারও স্তম্ভের ন্যায় সামনে ঘিরে দাঁড়িয়ে। না, এক্ষেত্রে বাঁ পা–কে ব্যবহার নয়। ফুটবল বিশ্বকে অবাক করে ডান পায়ের ঠিকানা লেখা পাশ ক্লদিও ক্যানিজিয়ার কাছে। হ্যাঁ, গোটা ম্যাচে একটাই দৌড়, আর হ্যাঁ, একটাই পাশ! যেখানে কারেকা, রিকার্ডো, মুলারদের এগারোটা করে কর্নার, এগারোটা গোলমুখী শর্টও ম্লান হয়ে যায়।
ফুটবলের রাজপুত্র তুমি। চালিত পায়ের চকিত চুম্বনে ফুটবলকে করেছিলে প্রেয়সী। সবুজ গালিচার আনাচে কানাচে ঝরে পড়ত তোমার নান্দনিক আস্ফালন। মাঠে বসে তোমার শতাব্দী সেরা দৃষ্টিনন্দন গোলের সাক্ষী থেকেছে এক লক্ষ চোদ্দ হাজার পাঁচশ আশি জন ফুটবল পিপাসু। ‘৮৬ তে পাঁচজন ব্রিটিশকে পায়ের ভেলকিতে বোকা বানিয়ে ম্যাচের ৫৪ মিনিটের মাথায় তিনকাঠির জালে বলকে জড়িয়ে তুমি ইতিহাস রচনা করেছিলে। বিপক্ষের বুকে কাঁপণ ধরাতে ধরাতে ফুটবল শৈলীতে যে ব্যাকরণ তৈরি করেছিলে তা আজও অনুকরণীয়। অসাধারণ দক্ষতায় পাশিং, বল কন্ট্রোল ও ড্রিবলিং এর সম্পৃক্তিকরণের রূপকথা লিখতে তুমি জায়গা নিতে মাত্র ১.৬৫ মিটার। রাইট উইং -এ পূর্ণ গতিতে ড্রিবলিং আর গোড়ালির অংশকে ব্যবহার করে রিভার্স ক্রস পাশে তুমি ফুটবল দুনিয়াকে আচ্ছন্ন রেখেছিলে।
তুমি চলমান ঘরনার উল্টো পথেই হেঁটেছো। বিতর্ক তোমাকে সঙ্গীও করেছে। তবুও তোমার জনপ্রিয়তা আন্দিজ, আল্পস, হিমালয়কে ছাপিয়ে গেছে। বাম পায়ে ফিদেল কাস্ত্রো, ডান হাতে চে গুয়েভারা আর হুগো সাভেজকে বুকের মধ্যে রেখে বাঁ পায়ের জাদুকর তুমি বরাবর পুঁজিবাদের জালে বাম দিক দিয়েই সমাজবাদের গোলটাই জড়িয়েছো।