দিব্যেন্দু দে
২০০৭ সালের কথা। তখনও সামনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। অনেকেই ভেবেছিলেন, রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন প্রণব মুখার্জি। যোগ্যতার বিচারে অন্যদের থেকে তিনিই এগিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু যোগ্যতা তো সবসময় শেষ কথা বলে না। সেই নির্বাচনে সেটা আরও ভাল করে বোঝা গিয়েছিল। গোটা দেশকে চমকে দিয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন প্রতিভা পাটিল। পাঁচ বছরে এমন কোনও ছাপ রাখতে পারেননি যার জন্য বলা যায়, তিনি যোগ্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
সেবার বামেরা চেয়েছিলেন, প্রণববাবুকেই রাষ্ট্রপতি করা হোক। সময়টা ভেবে দেখুন। ইউপিএ ওয়ান। সেবার বামেদের শক্তির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল কংগ্রেস। তাই বামেদের পরামর্শের বা দাবির আলাদা একটা গুরুত্বও ছিল। কংগ্রেসেরও অনেকেই চেয়েছিলেন প্রণববাবুই যান রাইসিনা হিলসে। তবু তাঁর যাওয়া হয়নি। কারণ, সোনিয়া গান্ধী চাননি।
সোনিয়া হঠাৎ একদিন ডেকে পাঠালেন প্রণববাবুকে। বিচক্ষণ প্রণববাবু বুঝে গিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কথা বলতেই তাঁকে তলব। মনের মধ্যে আশা–আশঙ্কার দোলাচল। ২০০৪ এ তাঁকে প্রধানমন্ত্রী না করে হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল মনমোহন সিংকে। এবার কি তাহলে তাঁকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে? সোনিয়া গান্ধী শুরুতেই বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি হিসেবে আপনার চেয়ে যোগ্য এইমুহূর্তে কেউ নেই। কিন্তু আপনি আমাকে বলে দিন, সরকারে এবং দলে আপনি যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন, আপনি চলে গেলে সেটা কে করবে? আপনার বিকল্প আপনিই খুঁজে দিন। আমি আজকেই রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে আপনার নাম ঘোষণা করে দিচ্ছি।’
ইঙ্গিতটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি বিচক্ষণ প্রণববাবুর। বুঝেই গিয়েছিলেন, সোনিয়া গান্ধী তাঁকে রাষ্ট্রপতি ভবনে চাইছেন না। চাইছেন দলে, চাইছেন সরকারের সংকট–মোচনে। এবারও তাঁর যোগ্যতাই তাঁর পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াল। এমন একজন দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন, যাঁরা রাজনীতির নানা খবর রাখেন, তাঁদের মধ্যে কজন চিনতেন!
পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০১২ সালে সোনিয়া কেন বেছে নিলেন প্রণববাবুকে? শুধুই কি তিনি যোগ্য বলে ? নাকি অন্য কোনও অজানা কাহিনি? সেবার বিভিন্ন রাজ্যে সরকার পরিবর্তন। কংগ্রেসের অন্য কোনও প্রার্থী হলে তাঁকে জিতিয়ে আনা মুশকিল। একমাত্র প্রণববাবুর নামেই সর্বসম্মতি হতে পারত। বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, যারা কংগ্রেসের সঙ্গে নেই, তারাও দু হাত তুলে সমর্থন জানাল প্রণববাবুকে। এমনকী বাল ঠাকরে পর্যন্ত জানিয়ে দিলেন, যতই এনডিএ–তে থাকি, এই নির্বাচনে আমরা প্রণববাবুকেই সমর্থন করব। কিন্তু এরপরেও কিছুটা দ্বিধা ছিল সোনিয়ার। নির্ভরযোগ্য প্রণবকে রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠানোয় পুরোপুরি সায় ছিল না। ঠিক সেই সময়েই আসরে নামলেন মমতা ব্যানার্জি। জানিয়ে দিলেন, তিনি প্রণব মুখার্জিকে কোনওভাবেই সমর্থন করবেন না। হাওয়ায় অন্য কয়েকটি নাম ভাসিয়ে দিলেন। তখনও তিনি ইউপিএ শরিক। তার ওপর তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সেখান থেকে কিনা সবচেয়ে জোরালো আপত্তি এল! সেই সময় নানা কারণে মমতার নানা অদ্ভুত দাবি দাওয়ায় ক্রমশ বিরক্ত সোনিয়া। মমতা বিরোধিতা করছেন, তখন তাঁর মধ্যেও জেদ চেপে গেল। প্রণববাবুর এক জীবনীতে প্রণববাবু নিজেই এই কথা স্বীকার করেছেন। মমতা যদি সেবার আমার বিরোধিতা না করত, তাহলে ২০১২ তেও হয়ত আমি রাষ্ট্রপতি হতে পারতাম না। মমতার বিরোধিতাই আমার কাছে শাপে বর হয়ে উঠল।