গত বছর এই দিনে ছিল শতবর্ষ পালনের লম্বা মিছিল। কী আশ্চর্য, তার ঠিক দু বছর আগে, এই দিনেই চিরতরে জীবনের ময়দান থেকে বিদায় নিয়েছিলেন স্বপন বল। স্বপন বলের স্মরণে মর্মস্পর্শী একটি লেখা লিখেছিলেন কুণাল দাশগুপ্ত। স্মৃতিকে একটু উস্কে দিতে সেই লেখাই ফিরে এল বেঙ্গল টাইমসে।
ফুটবলে না এলেই ঢের ভাল হত। এই ধরনের কপি করার সঙ্গে নিকট আত্মীয়ের ডেথ সার্টিফিকেট লেখার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? স্বপন বলকে আমি প্রথম দেখি গ্যালারি থেকে। আটের দশকের প্রথম দিকে। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে বসে বিস্ময়ের সঙ্গে ওর টিম নিয়ে মাঠে নামা দেখতাম। ওই ‘মাইরা ফেলুম কাইটা ফেলুম’ অভিব্যক্তি আমাকে বাধ্য করেছিল ওর গুণমুগ্ধ হতে। দলবদলের সময় ভরসা জোগাতো স্বপনদা। জানতাম, মোহনবাগান থেকে ঠিক কাউকে না কাউকে তুলে আনবেই। ফুটবলাররা গোল করত মাঠে, আর স্বপনদা মাঠের বাইরে।
প্রথম পরিচয় ১৯৯৭ সালে। ফেড কাপ সেমিফাইনালের আগে। তখন আমি একটা দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত। ম্যাচ প্রিভিউ করতে গিয়েছি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে। প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রি–অ্যাকশন নিচ্ছিলাম। হঠাৎ স্বপনদা, ‘ইতিহাস পরে লিখবি। আগে পেস্ট্রিটা খা।’ যত দিন গেছে, সম্পর্ক ততই পোক্ত হয়েছে। স্বপনদা যে সবসময় বাবা–বাছা করে কথা বলত, তা নয়। পছন্দসই কথা না হলেই এ কে ৪৭ চলত। বেরিয়ে আসত বাক্যালঙ্কার অব্যয়। রাগ করলেও পিঠে হাত দিয়েই ধমকের ধারাপাত আওড়াত। দীর্ঘদিন আই এফ এ–এর মুখপত্র কিক অফের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ক্লাবে গিয়ে হয়ত স্বপনদাকে একা পেয়ে উল্লসিত হয়েছি দলবদল সংক্রান্ত প্রশ্ন করব বলে। স্বপনদাকে প্রশ্ন করায় স্বপনদা গম্ভীর মুখে বলল, পার্ক স্ট্রিটের শো রুমে কি হাওড়া হাটের শাড়ি থাকবে? ইস্টবেঙ্গল ইস্টবেঙ্গলের মতোই টিম করবে, এখন পালা। একরাশ হতাশা নিয়েই ফিরে এসেছি।
আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ইস্টবেঙ্গলের এক ফুটবলার সেবার অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি আগেভাগে জানতে পেরে যাই। ক্লাবের এক শীর্ষকর্তাকে সেটা জানিয়ে দিই। ক্লাব কর্তারা সেই ফুটবলারকে অন্য ডেরায় সরিয়ে নিয়ে যান। পরে একদিন দুপুর বেলা ক্লাবে গেছি। ঢুকতেই স্বপনদা বলে উঠল, থ্যাঙ্ক ইউ কুণাল। বললাম, কেন? স্বপনদার উত্তর, সেটা তুই ভালই জানিস। বুঝেছিলাম, যে কাজটা আমি করেছিলাম, তাতে আমার চাকরি চলে যেতে পারত। আর সেটা উপলব্ধি করেই স্বপনদা আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিল।
স্বপনদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আই এফ এ ছেড়ে ইস্টবেঙ্গল সমাচারে আসার পরে। ঠিক করালম, দলবদলের গল্প গুলো ধারাবাহিকভাবে লেখা হবে, স্বপনদা লিখবে। তার মানে, স্বপনদার মুখ থেকে গল্প শুনে আমি লিখব। দেখলাম, প্লেয়ার তোলার ঘটনা তো বটেই, ক্লাবের ইতিহাসটাই গুলে খেয়েছে। সেই কীভাবে হাবিবকে সই করানো, ক্রিস্টোফার–চিবুজারকে নিয়ে আসা, গায়ে কাঁটা দিত। এসব গল্প শুনতে শুনতে আমারও অনেককিছু জানা হয়ে যেত, যা কোনও লাইব্রেরিতে, কোনও বই পড়ে জানা যেত না। এমনকী সবজান্তা গুগলও এখানে নিতান্তই অপারগ। এইসব গল্প শোনানোর লোক ময়দানে আর কেই বা আছে! এমন হত প্রায়, আমি আমার ঘরে বসে এক মনে লিখে চলেছি। হঠাৎ স্বপনদার গলা, আবার ইতিহাস লিখছিস। আগে চা খা।
আজ তো সত্যিই গলা শুকিয়ে আসছে। কে বলবে বলুন তো, পরে ইতিহাস লিখবি, আগে চা খা।
সত্যি বলছি, ফুটবলে না এলেই বোধ হয় ভাল হত।