দিব্যেন্দু দে
বাংলা ছবির রোমান্টিক জুটি বলতে কাদের বোঝায়? এই প্রশ্নটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। সবাই একটাই উত্তর দেবেন— উত্তম–সুচিত্রা। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো, এমন জুটির কথা কোনও ছবির পোস্টারে বা টাইটেল কার্ডে দেখেছেন কিনা! শুরুর দিকের কয়েকটা ছবিতে হয়ত উত্তম–সুচিত্রা পাবেন। কিন্তু অধিকাংশ ছবিতেই উত্তম–সুচিত্রা পাবেন না। তাহলে, একটু খুলেই বলা যাক। প্রথম দিকের দু একটা ছবি ছাড়া বাকি ছবিগুলোর পোস্টার লক্ষ করুন। এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। একটু সার্চ করলেই অনেক ছবির পোস্টার পেয়ে যাবেন। বা টিভিতেও মাঝে মাঝেই পুরনো ছবিগুলো দেখায়। ঘরে ডিভিডি থাকলে তো কথাই নেই। আরও ভাল করে ছবিগুলো দেখুন। টাইটেল কার্ডে সবার আগে সুচিত্রার নাম। আগে সুচিত্রা, তারপর উত্তম।
এমনটা কেন হয়েছিল? পরিচালকরা কি তুকতাক বিশ্বাস করতেন? নাকি লেডিজ ফার্স্ট এর তত্ত্ব মেনে চলতেন! আসলে, এটা ছিল সুচিত্রার একটা শর্ত। পরিচালকদের কাছে তিনি শর্ত দিতেন, পোস্টারে আমার নাম উত্তম কুমারের আগে রাখতে হবে। উত্তম কুমার ক্রমশ মহানায়ক হয়ে উঠছেন। পরিচালক–প্রযোজকরা চাইছেন, তাঁর ছবিতে উত্তম কুমার কাজ করুন। তাঁকে ভেবেই চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে। অথচ, সেই মহানায়ককেও কিনা সুচিত্রার দেওয়া শর্ত মেনে নিতে হচ্ছে। অন্য কোনও নায়িকা যদি এমন শর্ত আরোপ করতেন, উত্তম কুমার নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে ছবি করতেন না। অন্য নায়িকা এমন শর্ত দেওয়ার সাহসও পেতেন না। কিন্তু সুচিত্রা বরাবরই অন্যরকম। আর দশজনের সঙ্গে তাঁর অনেক ফারাক। তাই তিনি অবলীলায় শর্ত দিতে পারেন, আমার নাম আগে দিতে হবে। আর উত্তম কুমারকেও সেই শর্ত হজম করতে হয়। পরের দিকে আমরা ছবির টাইটেল কার্ডে অন্য একটা ব্যাপার দেখতে পাই। শুরুতে সুচিত্রার নাম। পরে একের পর এক পার্শ্ব অভিনেতার নাম। সবার শেষে লেখা ‘এবং উত্তম কুমার’। এই ‘এবং উত্তম কুমার’ দেখে অনেকে ভাবতেই পারেন, এটা উত্তম কুমারের একটা অভিনব স্টাইল। আসলে, তিনিও একটা সম্মানজনক রাস্তা খুঁজছিলেন। শুরুতে যখন সুচিত্রার নাম রাখতেই হবে, তার পরে কেন তিনি থাকবেন! তার চেয়ে বরং একেবারে শেষে ‘এবং উত্তম কুমার’ হওয়াই ভাল।
কে বড়, সেই তর্ক তোলা থাক। তবে উত্তম কুমারও বুঝতেন, তাঁর জনপ্রিয়তার অনেকটাই নির্ভর করছে সুচিত্রার ওপর। অন্য নায়িকাদের সঙ্গে যতই ছবি করুন, বাঙালি সবসময় উত্তম–সুচিত্রা জুটিকেই দেখতে চেয়েছে। এই জুটিকে দেখার জন্যই সব কাজ ফেলে কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন দিয়েছে। সেই জন্যই কি পরের দিকে উত্তমের সঙ্গে ছবির সংখ্যা কমে গেল? সুচিত্রা যে তার নাম আগে লেখার জন্য শর্ত আরোপ করেছিলেন, তা তিনি নিজেই বেশ কয়েকবার স্বীকার করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটেই বলেছেন, উত্তমের সঙ্গে আমার এত ছবি, কিন্তু আমি প্রোডিউসারকে বলেছিলাম, আমার নাম বিজ্ঞাপনে আগে দিতে হবে। তারপর সব ছবিতে ‘সুচিত্রা–উত্তম’, ‘উত্তম–সুচিত্রা’ নয়।
ওঁদের জুটির প্রথম ছবি সাড়ে চুয়াত্তর। ১৯৫৩ সালে। সেই ছবি অবশ্য পুরোপুরি উত্তম সুচিত্রার ছিল না। সেটা অনেক বেশি ছিল তুলসী চক্রবর্তী–মলিনা দেবীর ছবি। উত্তম–সুচিত্রা জুটির প্রথম হিট ছবি পরের বছর, অগ্নিপরীক্ষা। ছ বছর চুটিয়ে দুজন অভিনয় করে গেলেন। একষট্টি সাল থেকে লক্ষ করে দেখুন। সুচিত্রাও ছবি করা কমিয়ে দিলেন। একষট্টিতে মুক্তি পেল একটাই ছবি— সপ্তপদী। বাষট্টিতেও একটাই ছবি— বিপাশা। দুটোতেই নায়ক উত্তম। এরপর পাঁচ বছরের ব্যবধান। সাতষট্টিতে উত্তমের সঙ্গে গৃহদাহ, উনসত্তরে কমললতা। তার দু বছর পর নবরাগ। উত্তমের সঙ্গে শেষ ছবি পঁচাত্তরে, প্রিয় বান্ধবী।
না, তারপর উত্তমের সঙ্গে আর কোনও ছবিই করা হয়নি সুচিত্রার। শেষ দু বছরে দুটি ছবি। দুটোই সৌমিত্রর সঙ্গে। ছিয়াত্তরে দত্তা, আঠাত্তরে প্রণয়পাশা। অনেকে ভাবেন, উত্তমের মৃত্যুর পরেই উত্তম–সুচিত্রা জুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু সুচিত্রার ছবির তালিকাই বলে দিচ্ছে, উত্তমের সঙ্গে শেষ ষোল বছরে সুচিত্রার ছবির সংখ্যা মাত্র ছয়। অবশ্য বাঙালি এসব পরিসংখ্যান নিয়ে কোনওকালেই তেমন মাথা ঘামায়নি। সুক্ষ সুক্ষ ব্যাপারগুলোও আম বাঙালির অনুভূতিতে ধরা দেয় না। তারা উত্তম–সুচিত্রা জুটি বলতেই নস্টালজিক। যত দিন যাবে, পুরনো মানুষদের এই নস্টালজিয়া থেকেই যাবে। চারপাশে যা কিছু ঘটছে, তা চোখ মেলে দেখাও যায় না। তার চেয়ে বরং এই নস্টালজিয়া দীর্ঘজীবি হোক।
(ওপেন ফোরাম। পাঠকের মুক্তমঞ্চ। এরকম আকর্ষণীয় ফিচার আপনিও লিখতে পারেন। তবে তা নিছক মনগড়া নয়। লেখার পেছনে তথ্য ও যুক্তি থাকতে হবে। পাঠিয়ে দিন বেঙ্গল টাইমসের ঠিকানায়। ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com)