সরল বিশ্বাস
বাংলায় ৪২ সাংসদের মধ্যে জয়ের পেছনে কার কৃতিত্ব সবথেকে বেশি? কার ক্যারিশ্মা সবথেকে বেশি? কোনও সন্দেহ নেই, উত্তরটা হল অধীর চৌধুরি। বাম, তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস — সব শিবিরই এই ব্যাপারে একমত হবেন। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে হবেন।
কী কঠিন লড়াইটাই না আপনাকে লড়তে হয়েছে! একেবারে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই বলতে যা বোঝায়, তাই। আপনাকে হারাতে সবথেকে বেশি আদাজল খেয়ে নামা হয়েছিল। সেখান থেকে জয় পেয়েছেন। বামেরা পাশে ছিল, বিজেপি তুলনামূলক দুর্বল প্রার্থী দিয়েছিল, এগুলো মাথায় রেখেও বলব, আপনার কৃতিত্ব অনেক বেশি।
আপনি টানা পাঁচবারের এমপি। তবু আপনি যে কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেতা হতে পারেন, এটা মাথাতেও আসেনি। আপনার লড়াইকে উপযুক্ত স্বীকৃতিই দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। হঠাৎ যেদিন আপনার নাম ঘোষণা হয়েছিল, সবার মনেই কম–বেশি আনন্দের জোয়ার। আপনার নামে কী কী অভিযোগ, কী কী মামলা, এসব আর মনে রাখতে ইচ্ছেও করে না। যদি সেই অভিযোগগুলো সত্যি হয়েও থাকে, তাতেও কিছু যায় আসে না। তা নিছকই অতীত জীবন বলে মনে হয়। অধীর চৌধুরি মানে সেই মানুষটা যিনি মাথা উঁচু রেখে লড়াই করেন। অধীর চৌধুরি মানে সেই মানুষটা, যাঁকে নতিস্বীকার করানো যায় না।
শুরুর তিনটে অনুচ্ছেদ জুড়ে প্রশস্তি গাওয়া হল। এটা একেবারেই লোকদেখানো নয়, মন ভোলানো নয়। কিন্তু এই প্রশস্তি গাওয়ার জন্য এই খোলা চিঠি নয়। বরং পরের দিকে যেগুলো লিখতে যাচ্ছি, তাতে উল্টো সুরই থাকবে। সূত্রের খবর, আপনাকে নাকি পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করা হবে। এতেও বাঙালি হিসেবে হয়ত খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু হতে পারছি না। বরং অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছি। সবিনয়ে অনুরোধ করছি, এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। এটা একটা মস্তবড় ফাঁদ। বোঝার চেষ্টা করুন।
আপনি পাঁচবারের সাংসদ। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি কী জিনিস, আমার থেকে আপনি ঢের ভাল জানেন। এই কমিটির কাজ কী, তা তো আপনার অজানা নয়। বিরোধী দলের কাউকে এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি সরকারি গাড়ি পান, নানা সুযোগ সুবিধা পান। সবথেকে বড় কথা, সিএজি থেকে শুরু করে সরকারি আয় ব্যয়ের নানা খতিয়ানে চোখ বোলানোর সুযোগ পান। বিভিন্ন অডিটের ফাইল চলে আসবে পিএসি চেয়ারম্যানের কাছে।
আমাকে যদি কেমিস্ট্রিতে কারও পিএইচডি থিসিস পড়তে দেওয়া হয়, আমি কি মানে বুঝব? যদি কোয়ান্টাম থিওরি বা অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব নির্ভর কোনও বই দেওয়া হয়, একই দশা হবে। কারণ, এটা আমার বিষয় নয়। এটা বোঝা আমার কম্ম নয়। পিএসি চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার ভূমিকাও অনেকটা সেরকমই হবে। ওখান থেকে সরকারের খুঁত খুঁজে বের করতে গেলে যে পর্যায়ের পড়াশোনা লাগে, যে পর্যায়ের মেধার চর্চা লাগে, তা আপনার নেই। এমনিতেই সেসব জটিল ভাষায় লেখা। সেই লেখা পড়লেই যে বুঝবেন, এমন নয়। বিটুইন দ্য লাইনস পড়ে তবে কিছুটা উদ্ধার হতে পারে। কোথাও প্রশস্তির মধ্যে থেকেই অসঙ্গতি খুঁজতে হবে। কোথাও অন্যান্য বছরের সঙ্গে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা টানতে হবে। এসব এক্সপার্টদের কাজ। এটা সৌগত রায় বা শশী থারুররা যত ভাল বুঝবেন, আপনার পক্ষে তেমনটা বোঝা সম্ভব নয়। এই সহজ সত্যিটা বোঝার চেষ্টা করুন।
হিন্দি বা ইংরাজি না জানলে কয়েকমাসের চেষ্টায় কিছুটা আয়ত্ব করা যায়। অনেকটা করেওছেন। লোকসভায় ভাষণটাও ঘসতে ঘসতে কিছুটা আয়ত্বে এসে যায়। কিন্তু তার সঙ্গে পিএসি–র গোপন ফাইল দেখাকে গুলিয়ে ফেলবেন না। এই বিদ্যেটা হঠাৎ করে অর্জন করা যায় না। আপনাকে যদি একুশ ফুট লং জাম্প দিতে বলা হয়, বারো সেকেন্ডে একশো মিটার দৌড়তে বলা হয়, হেমন্তর মতো গান গাইতে বলা হয়, যোগেন চৌধুরির মতো ছবি আঁকতে বলা হয়, এগুলোর কোনওটাই পারবেন না। এই বয়সে এসে সেই স্কিল আয়ত্ব করা যায় না। তাই চেষ্টা না করাই ভাল।
পিএসি–র ক্ষেত্রেও আপনাকে অনুরোধ, ওই চ্যালেঞ্জটা নিতে যাবেন না। জনপ্রিয়তা, সাহস, লড়াই এগুলো আপনার আছে। কিন্তু সেই মানের পড়াশোনা বা মেধা নেই, এটা মানতে শিখুন। এমন লোকের হাতে গোপন ফাইল গেলে, সরকারের সুবিধে হয়। তারা অনেক নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। এর চোখে বড় বড় অনিয়মগুলো ধরাই পড়বে না। আপনি পিএসি চেয়ারম্যান হলে তা শুধুমাত্র বিজেপির জন্য খুশির খবর।
কথাগুলো অপ্রিয় হলেও আসা করি ভেবে দেখবেন। সংসদীয় দলনেতা হিসেবে ভাষণ দিন, ঠিক আছে। কিন্তু পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির দায়িত্ব ভুলেও নিতে যাবেন না। যাঁরা এর যোগ্য, তাঁদের হাতেই ছেড়ে দিন।