রবীন্দ্রনাথ এমন একটা বিষয়, যাকে ছাড়া চলে না। ঘর সাজাতে রবি ঠাকুর। নিজেকে বুদ্ধিজীবী জাহির করতেও ভরসা সেই রবি ঠাকুর। ট্রাফিক সিগনালেও তিনি, রেস্তোরাঁর মৃদু মন্দ আলোতেও তিনি। তাঁর নিস্তার নেই। লিখেছেন অন্তরা চৌধুরি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নতুন করে রচনা লেখার ইচ্ছে আমার নেই। কারণ সেই ক্লাস টু থেকে লিখে আসছি। তথ্য সমৃদ্ধ লেখা থেকে আপাতত বিরতি নিয়েছি। রবীন্দ্র যাপন করতে খুব ইচ্ছে করে। অনেকে বলতেই পারেন, ‘কে বারণ করেছে?’ সত্যি তো, কেউ বারণ করেনি। কিন্তু ঠিকঠাক রবীন্দ্র যাপন কি করা সম্ভব? বাঙালি যে শুধু পঁচিশে বৈশাখেই রবীন্দ্র যাপন করে তা তো নয়, প্রায় সারা বছর ধরেই করে। আসলে ‘রাবীন্দ্রিক’ হওয়ার মধ্যে একটা আলাদা আভিজাত্য আছে।
রাস্তাঘাটে মাঝেমাঝেই চোখে পড়ে, কোনও এক বঙ্গললনা সুসজ্জিত হয়েছে রবীন্দ্র–গানের লাইন লেখা শাড়িতে। কাঁধে শান্তিনিকেতনের ব্যাগ। কপালে একটা বেশ বড় সাইজের টিপ, খোঁপায় ফুল। সকলের মাঝে থেকেও কিন্তু সে একটা আলাদা মাত্রা পেয়ে যায়। ব্যক্তিত্বের সীমারেখার পারদ ক্রমশ চড়তে থাকে।
পুরুষরাও ‘রাবীন্দ্রিক’ হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে কোথাও এতটুকু পিছিয়ে নেই। বাটিকের পাঞ্জাবি, মুখে খোঁচা দাড়ি আর শান্তিনিকেতনের ব্যাগ নিয়ে সেও যে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা, যে কোনও উপায়ে তাকে এটা প্রমাণ করতেই হবে। আবার মোবাইলের রিংটোনেও রবীন্দ্রনাথ! হঠাৎ জনৈক সঙ্গীত শিল্পীর কন্ঠে ভেসে উঠল— ‘আমার এ পথ, তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে’।
আমাদের প্রেমেও রবি, আবার বিরহেও রবি। অর্থাৎ, নিজের একটা আলাদা identity তৈরি করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আদর্শ ঘরানা। মাঝে মাঝে ভাবি, জীবনের এমন কোনও মুহূর্ত কি আছে, যার জন্য রবি ঠাকুর গান লিখে যাননি। এখন তো আবার বাংলা সিরিয়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত নতুন ফ্যাশন। ট্রাফিক সিগনালে রবি ঠাকুর চো অনেকদিন ধরেই বেজে চলেছেন। রেস্তোরা, বাসেও বাজছেন। বাঙালির শয়নে স্বপনে মননে জাগরণে আনন্দে বিরহে সবেতেই রবি ঠাকুর, একথা আমার আগেও অনেকজন বলেছেন।
দোলের সময় শান্তিনিকেতন না গেলে সমাজে status নষ্ট হওয়ার একটা ভয় কাজ করে। তবে সেটা সকলের নয়। সারাজীবনে রবীন্দ্রনাথের একটিও বই না পড়লেও কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু ড্রয়িংরুমে রবীন্দ্র রচনাবলী থাকা চাইই। ইন্টেরিয়র ডেকরেটররাও নাকি তেমনটাই বলেন। যে কোনও অনুষ্ঠানে ব্যাকগ্রাউণ্ডে যদি হালকা সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলে, তাহলে অতিথিরা রুচির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকী দুর্গা পুজোতেও জলতরঙ্গে রবি ঠাকুরের মিউজিক চালিয়ে পুজো কমিটি পেয়ে যাচ্ছে শ্রেষ্ঠ পরিবেশ মনষ্কতার পুরস্কার।
তার মানে, নিজেদের ইমেজ ধরে রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ দরকার। কিন্তু রবি ঠাকুরের সমসাময়িক এবং পরবর্তীকালে অনেক নতুন সূর্যের আবির্ভাব হয়েছে। তাঁদের অনেকেরই নিজস্ব ঘরানা থাকলেও বাঙালি সেটা গ্রহণ করল না কেন? Sofishticated মনোভাবে কি কোথাও ভাঁটার জন্ম নিয়েছিল? সাহিত্য জগতে যদি কারও লেখায় রবীন্দ্র প্রভাব পাওয়া যায়, তখন তো আমরা সমালোচনার ঝড় তুলি। সেই লেখকের নিজস্বতা কিছু নেই বলে মন্তব্য করি। রবীন্দ্রনাথের লেখার স্টাইল নাকি এখন ব্যাকডেটেড। উত্তর আধুনিকতা এখন ফ্যাশন। কত বড় বড় ভাষণ যে শুনতে হয়, ‘বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া কিছু বুঝল না।’ তার প্রভাব মুক্ত হতে গিয়ে আধুনিক হওয়ার ম্যারাথনে অংশগ্রহণ না করলে আর যাই হোক, কফিহাউসে মুখ দেখানো যায় না। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে অসহায় মুহূর্তে আবার সেই বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে রবি ঠাকুর—
নদীর বুকে যে যার ডিঙা দে ভাসিয়ে
জীবন নদী খেয়াল খুশি যায় বয়ে যায়।
কোন সাগরে মিলবে নদী বেলা শেষে
জোয়ার ভাঁটার খেলা সে পথ বোঝারে দায়।
রবি ঠাকুর বলেছিলেন, ‘কমল হীরে পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার।’ কিন্তু শিক্ষিত বাঙালির এই বিদ্যে আর কালচারের মধ্যেই যত ঘাত–প্রতিঘাত। নিজেদের ইগো নিয়ে আমরা সদা ব্যস্ত। যখন যেমন তখন তেমন–এটাই তো এখন আমাদের আদর্শ, তাই নয় কি?
তাই শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ রবি ঠাকুরের কাছেই-
‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে’।