রবি কর
এতদিনে মশাই, এতদিনে। এতদিনে আমার সঙ্গে আমার বউয়ের মতের মিল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখনও মতের মিল হয়নি, কিন্তু হবে। হাওয়া যা বুঝছি, তাতে শিগগির হবে, হতেই হবে।
বউ কী জিনিস, তা তো আপনারা জানেন। বউয়ের সঙ্গে পৃথিবীতে একটা জিনিসেরই মিল আছে। সেটা হল পাকিস্তান। অর্থাৎ, তার সঙ্গে মতের মিল অসম্ভব। তাকে যতই ভালবাসার কথা বলুন, সে আপনার ওপরে বিস্ফোরণ ঘটাবেই। আমরা সাংবাদিকরা বউ আর মালিক ছাড়া কাউকে ভয় করি না। এই দুইয়ের জ্বালায় আমাদের জীবন চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। বেঙ্গল টাইমসের মালিক আমাকে রোজই বলে, রবিবাবু, দেশ বিদেশের খবরাখবর একটু রাখুন। নইলে চাকরি বাঁচাতে পারবেন না। কিন্তু খবর রাখব কী করে? বাড়িতে সর্বক্ষণ স্টার জলসা আর জি বাংলা চলছে। সেগুলো বন্ধ করে খবরের চ্যানেল চালাতে গেলেই, পাকিস্তান মানে বউ, গোলাগুলি ছুঁড়তে শুরু করবে।
বউকে কত করে বলি, ঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন দেখো। তোমার সিরিয়ালের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তৃণমূলের সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় আর বিজেপি–র রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন একসঙ্গে ক্যাঁচাল শুরু করবে না, কোথায় লাগে কৃষ্ণকলির গুরুমা আর রাণুর শাশুড়ি। সিরিয়ালে তবু একটা চরিত্র অন্য চরিত্রকে ডায়লগ শেষ করার চান্স দেয়। খবরের চ্যানেলে কেউ কাউকে বলতে দেয় না। সবাই নিজে নিজে বাক স্বাধীনতা উপভোগ করে।
কিন্তু বউ আমার কথা শুনতে রাজি নয়। বলে, তোমাদের খবরের চ্যানেলে লড়াই থাকে তো প্রেম থাকে না। প্রেম থাকে তো পরকীয়া থাকে না। পরকীয়া থাকে তো গ্ল্যামার থাকে না। সিরিয়ালে দেখ। যেমন ষড়যন্ত্র, তেমনি প্রেম। একেকজনের দু–তিনটে করে প্রেম। তোমাদের খবরের চ্যানেল মানে তো কয়েকজন ম্যাড়মেড়ে ব্যাটা ছেড়ে বিড়বিড় করে। ওর আবার দেখব কী?
কিন্তু কয়েকদিন হল বউয়ের মতিগতি বদলে গেছে। আমি ঘরে ঢুকলেই বলে, কী গো খবর কী, কবে থেকে শুরু হবে? কী গো, কবে জয়েন করবে? তোমাদের খবরের চ্যানেলে কবে থেকে শুরু হবে সেইসব গল্প। আমার বউ কীসের কথা বলছে বলুন তো! বুঝলেন না! তাহলে আপনি কোনও খবরই রাখেন না। বউ বলছে, শোভন আর বৈশাখীর কথা। কাল ইলেকশান ডিক্লেয়ার হয়ে গেল। বউযের উৎকণ্ঠা দেখে কে? সিরিয়ালের মুখে ঝাঁটা মেরে সে বলছে, খবরের চ্যানেল চালাও, ওরা জয়েন করল কিনা দেখি। নির্বাচন কমিশনারের সাংবাদিক সম্মেলন শুনতে সে আগ্রহী নয়। সব্যসাচী দত্ত কী করবে, তা জানতে সে আগ্রহী নয়। বাম–কং জোট হল কিনা, তাতে তার কোনও আগ্রহ নেই। এমনকী কে কটা আসন পেতে পারে, তা নিয়েও তার মাথাব্যথা নেই। তার একটাই প্রশ্ন, কবে শোভন–বৈশাখী বিজেপিতে যাবে। বলছে, হ্যাঁ গো, ভোটে দাঁড়াবে তো? কোন আসনে দাঁড়াবে? বিপক্ষে কি রত্না দাঁড়াবে? তিতিবিরক্ত হয়ে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললাম, রাজ্যে কটা লোকসভা আসন, তাই জানো না। কোথায় কে দাঁড়াবে, তাতে তোমার কী?
ভেবেছিলাম, বউ রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করবে। কিন্তু ও মা, হাসতে হাসতে গা ঘেঁসে বসে বলল, কটা আসন জেনে আমার কী? আমার জানা দরকার, বৈশাখী আর শোভন কোন আসনে দাঁড়াবে।
—কেন, তুমি কি বিজেপি সমর্থক নাকি?
—দূর দূর, আমি শুধু মেগা সিরিয়ালের সমর্থক। শোভন বা বৈশাখী ভোটে দাঁড়ানো মানেই, বিপক্ষে রত্না দাঁড়াবে। ভোটে না দাঁড়ালেও প্রচারে তো নামবেই। তারপর ...।
—তারপর কী?
তারপর রত্না, শোভন, বৈশাখী সবাই মন কী বাত বলতে শুরু করবে। রাফাল, পুলওয়ামা, নীরব মোদি, অভিনন্দন, মহাজোট ওসব নিয়ে বাকি দেশ মাথা ঘামাক। আমরা খবরের চ্যানেল চালিয়েই মেগা সিরিয়াল দেখব। বৈশাখী কী সেজেগুজে আসবে! হ্যাঁ গো, রানী রাসমণীর গায়ে বেশি গয়না না বৈশাখীর গায়ে! আহা, অত সেজেগুজেও মেয়েটা কী সুন্দর কাঁদে।
আর রত্না! উস্কো খুস্কো হয়ে, সেই একবার আমাদের গ্রামে ‘সিথির সিঁদুর ফিরিয়ে দাও’ যাত্রা হয়েছিল, ঠিক সেইরকম। সিরিয়ালে হয় জানো তো, বরের মন না পেলে বউরা অমন ঝোড়ো কাকের মতো হয়ে যায়। রত্নাও বোধ হয় সিরিয়াল দেখে, জানো!
আর কী সব ডায়লগ হবে গো! ভাবলেও নাওয়া খাওয়া মাথায় ওঠে। কে কার সঙ্গে গোপনে কোম্পানি খুলল, কে কার জন্মদিনের কেকে বিষ মেশাচ্ছে, কে কার বিরুদ্ধে সুপারি কিলার লাগাচ্ছে। যাই বল, তোমাদের খবরের চ্যানেলগুলোই ভাল। আমাদের সিরিয়ালে এতকিছু হয় না।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু অন্য খবরও তো দেখতে হবে।
বউ চোখমুখ লাল করে বলল, অন্য খবর আবার কী? কোনও অন্য খবর নেই। শোনা, সাফ কথা বলে দিচ্ছি। আগামী একমাস তোমার সঙ্গে আমার মতের মিল হবে। সব মেগা সিরিয়াল বন্ধ। দুজনে পাশাপাশি বসে খবরের চ্যানেল দেখব। কিন্তু শোভন–রত্না–বৈশাখী ছাড়া অন্য কোনও খবর দেখা চলবে না।
আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু যদি বিজেপি বৈশাখীকে টিকিট না দেয়! যদি টিএমসি রত্নাকে প্রচারে না নামায়! বউ চোখ পাকিয়ে বলল, নামাতেই হবে। বিজেপি জানে, রাফাল থেকে মানুষের মন ঘুরিয়ে দেওয়ার এটাই সুযোগ। টিএমসি–ও জানে, এয়ার স্টাইক থেকে মানুষের মন ঘোরানোর এটাই সুযোগ। আগামী দুমাস নো ভারত–পাকিস্তান, নো এয়ার স্টাইক। বাংলার সব খবরের চ্যানেলে শুধুই শোভন–বৈশাখী–রত্না। একবার খালি জয়েন করতে দাও।