ব্রিগেড বুঝিয়ে দিল, মিডিয়ার প্রচার কতটা ফাঁপা

ধীমান সাহা

ব্রিগেডে ঠিক কত লোক হয়েছিল?‌ এটা চিড়িয়াখানা বা মেট্রো রেল নয়। এমনকী ইকো পার্কও নয়। তাই টিকিট বিক্রি থেকে হিসেব পাওয়ার উপায় নেই। পুলিশ একটা হিসেব দেয় ঠিকই, কিন্তু পুলিশের যা ভাবমূর্তি, তাতে সেই হিসেবে সিংহভাগ জল থাকবে, তা নিয়েও সন্দেহ নেই। তৃণমূল নেতৃত্ব এত বেশি ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ নির্ভর, সত্যিকারের ছবিটা তাঁরা কখনই ঠিকঠাক দেখতে পান না। বামেরা কমিয়ে বলবে, সেটাই স্বাভাবিক। আবার মিডিয়া গত কয়েকদিন যে হারে ব্রিগেডের প্রচার করে চলেছে, তাদের পক্ষেও সত্যিটা বোঝা বা ছাপা মুশকিল। পুলিশের যেমন কণ্ঠরুদ্ধ, মিডিয়ারও অনেকটা সেই রকমই।

আসলে, যত দিন যাচ্ছে, মূলস্রোত মিডিয়া ততই যেন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। কোথাও প্রলোভন। কোথাও ভয়। যাকে যেটা দিয়ে কাজ হয়। কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে ব্রিগেড দেখে আসছি। আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বলতে পারি, যা প্রচার হয়েছে, সে তুলনায় কিছুই ভিড় হয়নি। যা লোক হয়েছে, সেটা জোগাড় করা মোটেই সহজ বিষয় নয়। কিন্তু যা হওয়ার কথা কদিন ধরে প্রচার হচ্ছে, সে তুলনায় এটাকে পর্বতের মূষিকপ্রসবই বলতে হবে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। নানা সময়ে ব্রিগেডের চেহারা কেমন ছিল, তা ছবিতেও ফুটে উঠছে। বিশেষ করে ওপর থেকে তোলা ছবিগুলোতে বোঝা যাচ্ছে, মাঠ একেবারেই ভরেনি। বেশিরভাগ অংশই ফাঁকা।

হলফ করে বলা যায়, তৃণমূল যখন বিরোধী ছিল, তখন এর থেকে বেশি লোকের সমাগম হত। অর্থাৎ, সর্বকালের সেরা তো দূরের কথা। এটা তৃণমূলের প্রথম পাঁচটা ব্রিগেডের মধ্যেও পড়বে কিনা সন্দেহ। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত লোক সমাগম হল না কেন?‌ কতগুলো কারণ খোলা মনে আলোচনা করা যাক।

brigade6

১)‌ লোক হয়ত আরও বেশিই এসেছিলেন। কিন্তু তাঁরা এদিক–‌ওদিক ঘোরায় ব্যস্ত ছিলেন। মাঠে ভিড়ের মধ্যে ঢুকতে চাননি।
২)‌ তিনদিন আগে থেকে লোক আনা হয়েছিল। যাঁরা তিন দিন আগে এসেছেন, তাঁদের ফেরার তাড়া থাকেই। তাঁরা আগে ফিরতে চেয়েছেন। কেউ কেউ সভা শুরুর আগেই ট্রেন ফাঁকা থাকবে ভেবে স্টেশনে ভিড় করেছেন।
৩)‌ যখন তৃণমূল বিরোধী ছিল, তখন যাঁরা এসেছেন, ভালবেসে এসেছেন। কাউকে খুশি করার তাগিদে নয়। কিন্তু এখন যাঁরা আসছেন, তাঁদের নানারকম দায়। তাঁরা এসেছেন কাউকে খুশি করতে।
৪)‌ ধরা যাক, কারও মেয়ে কন্যাশ্রীর সাইকেল পেয়েছে। পাড়ার তৃণমূল নেতারা জোর করেছেন, যেতেই হবে। তাঁর পক্ষে ‘‌না’‌ করা সম্ভব হয়নি। এসেছেন। হাজিরা দেওয়া হয়ে গেছে। এবার নিজের মতো করে ফেরার গাড়ি ধরেছেন। অর্থাৎ, হাজির থাকার আন্তরিক তাগিদ ছিল না। আসতে হবে, তাই এসেছেন। শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি।
৫)‌ নেতাদেরও কোটা বাঁধা ছিল। কাকে কত লোক আনতে হবে, কটা বাস আনতে হবে। সেই কোটা পূরণ করেছেন। তারপরই ফেরার সময় ভিড় থাকবে ভেবে আগে কেটে পড়েছেন।
৬)‌ টানা পাঁচ ঘণ্টার সভা। এতক্ষণ শোনার ধৈর্য বা মানসিকতা, কোনওটাই তৃণমূল সমর্থকদের থাকার কথা নয়।
৭)‌ প্রায় সব ভাষণই চর্বিত চর্বন। তেমন বৈচিত্র‌্য নেই। তার ওপর অধিকাংশই বলেছেন হিন্দিতে বা ইংরাজিতে। গ্রাম থেকে আসা অনেকেই বুঝতে পারেননি।
৮)‌ জেলায় জেলায় এত বেশি প্রচার হয়েছে, অর্ধেক শক্তিক্ষয় তখনই হয়ে গেছে। যুবরাজের খ্যাতি বাঁচাতে একবার জেলায় বড় জমায়েত করতে হয়েছে। তখন যাঁদের জোর করে জড়ো করতে হয়েছে, কয়েকদিন পরেই আবার তাঁদের কলকাতায় আনা খুব সহজ ছিল না। জেলায় জেলায় সেই সভাগুলোই হয়ত ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে।
৯)‌ বিনা লড়াইয়ে জিততে জিততে নিজেদের সঠিক সাংগঠনিক শক্তি যাচাই করে উঠতে পারেনি শাসকদল। সব পঞ্চায়েতে যখন দখল নেওয়া গেছে, তখন দল বেঁধে সবাই বোধ হয় ব্রিগেডেও চলে আসবে, এরকম একটা আত্মতুষ্টি হয়ত এসে গিয়েছিল।
১০)‌ সাইবেরিয়ায় থাকা লোকের মনে হতে পারে, সারা পৃথিবীই বোধ হয় বরফে মোড়া। মরুভূমির দেশের লোকের মনে হতে পারে, গোটা পৃথিবীই হয়ত বালিতে ভর্তি। আসলে, মিডিয়ার এই জো–‌হুজুরগিরি দেখতে দেখতে সবাই ভেবেই নিয়েছিলেন, ঐতিহাসিক কোনও সমাবেশ হচ্ছে। মিডিয়ার প্রচার যে বাস্তব থেকে অনেকটাই দূরে, সেটা আরও একবার বোঝা গেল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.