সুগত রায়মজুমদার
সামনেই লোকসভা নির্বাচন। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। সব দলের তৎপরতা তুঙ্গে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। কাকে ভোট দেবেন। সমস্ত সংবাদমাধ্যম ব্যস্ত নির্বাচন ঘিরে সমীক্ষা নিয়ে। ইতিমধ্যে একটি বেসরকারি চ্যানেল সমীক্ষায় বলে ফেলেছে, সাম্প্রতিক ৫টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি–র হাল অত্যন্ত খারাপ হলেও, লোকসভা নির্বাচনে সেই সব রাজ্যের জনগণ মোদির ওপরেই আস্থা রাখবেন। ফলে, সাধারণ মানুষ এখন ধন্দে।
প্রথমেই বলা যেতে পারে, ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যে বিপুল আসন নিয়ে দেশের ক্ষমতায় এসেছিল, সেই জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে পৌঁছেছে। বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি, নীরব মোদির কেলেঙ্কারি, রাফাল নিয়ে অনিয়ম, আম্বানিকে নানা সুযোগ দেওয়া, পেট্রোপণ্য দ্রব্যের বৃদ্ধির ফলে সব জিনিসের দামবৃদ্ধি এবং দেশে বহু কৃষকের আত্মহত্যা বিজেপি–কে অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। এ ছাড়াও মোদি বলেছিলেন, জিরো ব্যালেন্সে ১৫ লক্ষ টাকা দেবেন, তা এখন বিশবাঁও জলে। বিজেপি ২০০৩ সালে ৩টি বিধানসভায় জেতার পরেও ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের কাছে পর্যুদস্ত হয়। বিজেপি–ও অতীতের সেই ফলে আশাবাদী। বিজেপি–র প্রথম সারির নেতারা ভাবছেন, এবারও তাই ঘটতে চলেছে। যদিও অতীতের বিজেপি–র সঙ্গে এখনকার বিজেপি–র কোনও তুলনা চলে না। তখন অনেক দক্ষ রাজনীতিবিদ ও শরিক দলগুলি অনেক সঙ্ঘবদ্ধ হয়েও হার এড়াতে পারেনি। এবার তো বিজেপি সেই অনুকূল পরিস্থিতিতেই নেই। এ ছাড়াও দেশের মানুষের মধ্যে একটা মসৃণ বিভাজন তৈরি করতে চাইছে বিজেপি। ধর্মের রাজনীতি ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ কোনও দিনই প্রশ্রয় দেননি। সুতরাং পুনরায় ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেন কী করে!
মূলত, এখন সারা দেশে কোনও দলকেই আস্থা নিয়ে এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না। যেমন বিজেপি–র স্বেচ্ছাচারিতাকে মানুষ মেনে নিতে পারছে না। সরকারে এসে বিজেপি যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল,তার অনেক কিছুই পূরণ করেনি। এমনকী পূরণ করার সদিচ্ছাও ছিল না। সেজন্য সাধারণ মানুষ বিজেপি–কে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছে।
বিজেপি ছাড়া পরের স্থানেই রয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেসও সর্বভারতীয় দল। কংগ্রেসের হাল ধরতে পারেন একমাত্র রাহুল গান্ধী। কিন্তু তাঁরও ইমেজ একটু হাল্কা। তাঁর ‘পাপ্পু’ ইমেজ থেকে তিনি এখনও সম্পূর্ণ বেরোতে পারেননি। দক্ষ রাজনীতিবিদরা রাহুলকে এখনও অপরিণত মনে করেন। যদিও সেই ধারণা রাহুল অনেকটাই বদলে দিয়েছেন সাম্প্রতিক ৫ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে। তাঁর একার নেতৃত্বেই কংগ্রেস সম্প্রতি ৩টি বড় রাজ্য দখল করেছে। ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা এখন সারা দেশে তুঙ্গে। এটাকেই কংগ্রেস অস্ত্র করতে চাইছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদিরও একটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ছিল। সেটা রাহুলেরও আছে। এ ছাড়া কংগ্রেস এখনও গান্ধী পরিবারের বাইরে চিন্তাই করতে পারে না। রাহুলের সাম্প্রতিক ভূমিকায় দেশের মানুষ চমকে গেছে। এজন্য সকলে ভাবছেন, দেখা যাক একবার সুযোগ দিয়ে। সামনের লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের সব বিবাদ ভুলে কংগ্রেস পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। কিন্তু ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলির কাছে রাহুল কতটা গ্রহণযোগ্য হবেন, তা এখনই বলা মুশকিল। তিন রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই হয়েছে। এই তিন রাজ্যে আঞ্চলিক দল তেমন শক্তিশালীও ছিল না। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যেই কোনও না কোনও আঞ্চলিক দল নির্ণায়ক শক্তি। ফলে, অধিকাংশ রাজ্যেই ভোট ত্রিমুখী। সেইসব রাজ্যে সেই আঞ্চলিক দল একা লড়বে নাকি কংগ্রেস বা বিজেপির জোটে আসবে, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। আবার কেউ কেউ এখন হয়ত একাই লড়বে, ভোটের পরে পরিস্থিতি বুঝে অবস্থান নেবে।
তাই, এবারের লোকসভা নির্বাচনের সমীকরণ একটু অন্যরকম। সম্প্রতি বিজেপি খারাপ ফল করায় এনডিএ–র শরিক দলগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে, ভুল শুধরে নিতে চাইছে। আর কংগ্রেস ইতিমধ্যে কর্ণাটকের সংখ্যালঘু সরকারকে সমর্থন দিয়ে সুফল পাচ্ছে। এ ছাড়া ইউপিএ–র অতীতের শরিক দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছে। এজন্য কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম–কেও সঙ্গে নিতে চাইছে। কংগ্রেস চাইছে বাংলায় সিপিএম–কে সঙ্গে নিলে বিজেপি–বিরোধী ভোট এক বাক্সেই যাবে। সেই ধারণা ভুল না ঠিক, তা সময়ই বলবে।
তবে বেশিরভাগ রাজ্যেই জোটের সমীকরণ এখনও বিশ্বাসযোগ্য নয়। উত্তরপ্রদেশে ইতিমধ্যে সমাজবাদী দলের অখিলেশ যাদব ও বহুজন সমাজবাদী দলের নেত্রী মায়াবতী এখনই রাহুলের নেতৃত্বে নির্বাচনে লড়তে চান না। তাঁরা বলছেন, নির্বাচন পরবর্তীকালে নেতা ঠিক করবেন। চন্দ্রবাবু নাইডু কংগ্রেসের সঙ্গে জোটেই লড়তে চান। লালুপ্রসাদ যাদবের পুত্র তেজস্বী যাদবও কংগ্রেসের নেতৃত্ব মেনেই লড়তে চান। কিন্তু নীতীশ কুমার এনডিএ–তেই থাকবেন। এটাই এখন পর্যন্ত ঠিক। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পটনায়েক এখনও পর্যন্ত ঠিক করেননি, কী করবেন। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তো সাম্প্রতিক তিন রাজ্যের বিধানসভার ফলকে রাহুলের কৃতিত্ব মেনে নিতে চাননি। তিনি বলেছেন, মানুষের জয়। তিনি চান, বাংলা থেকে ৪২টি আসন নিয়ে গেলে তাঁর দল সরকার গড়ার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। ত্রিশঙ্কু হয়ে গেলে আঞ্চলিক দলগুলির গুরুত্ব আবার অনেকটাই বেড়ে যাবে। তখন তারাই সরকারকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করবে। সুতরাং রাজনৈতিক সমীকরণ অনেক জটিল জায়গায় দাঁড়িয়ে। সময়ই বলবে, পরবর্তীকালে কী ঘটবে।