মনোজ, কথা নয়, ব্যাটে মন দিন

স্বরূপ গোস্বামী

এই এক মুশকিল। একটু রান পেলেই শত্রু খোঁজা শুরু। এই ব্যাটা, কে আমার নামে কী বলেছিলিস?‌ দেখলি তো, কেমন সেঞ্চুরি করলাম। এবার কী বলবি?‌

বড় বড় তারকাদের মধ্যেও এই রোগটা ছিল। মনোজ তেওয়ারিরও বেশ ভালই আছে। তাই ডাবল সেঞ্চুরি করার পরেও কোনও প্রিয় মুখ মনে পড়ল না। যে মানুষটা কয়েকদিন ধরে তাঁর ভেতরের খিদেটাকে উস্কে দিলেন, সেই অরুণলালের কথা মনে পড়ল না। প্রথমে খুঁজতে চাইলেন সমালোচকদের। বোঝাই যাচ্ছে, বড় রানের ইনিংস খেলার থেকেও সমালোচকদের জবাব দেওয়াটাই যেন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

manoj tewari2

অনেক কাল্পনিক গল্পও ফেঁদে দিলেন। হ্যাঁ, গত কয়েকদিন ধরে মনোজের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। সবাইকে নিয়ে চলতে পারছেন না, টিমমেটদের উজ্জীবিত করতে পারছেন না, এমন সমালোচনা উঠছিল। নেতৃত্ব থেকে সরে গেলে মনোজ খোলা মনে, চাপমুক্ত হয়ে ব্যাট করতে পারবেন, এমন একটা ব্যাখ্যাও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু মনোজকে বাদ দেওয়া হোক, এমন দাবি তো ওঠেনি। সতীর্থ, নির্বাচক, প্রাক্তন ক্রিকেটার, মিডিয়া–‌কোনও মহল থেকেই এমন দাবি উঠেছিল বলে শোনা যায়নি। অথচ, মনোজ যেন সবাইকেই শত্রু ভেবে নিলেন।

এই হল মুশকিল। ছেঁদো কথায় কান দিতে গিয়ে নিজের ফোকাসটাকেই হারিয়ে ফেলা। বোঝাই যাচ্ছে, কয়েকদিন ধরেই মনে মনে ফুঁসছিলেন। ‘‌দেখিয়ে দেব’‌ মার্কা একটা রাগ মনে মনে পুষে রেখেছিলেন। প্রকাশও করে ফেলছিলেন। নেহাত রান পাচ্ছিলেন না। বোঝাই যাচ্ছে, কী করে ব্যাটিংয়ে উন্নতি করতে হয়, কী করে ত্রুটিগুলো শুধরে নিতে হবে, সেদিকে তেমন মনযোগ ছিল না। যেই রান পেলেন, অমনি শুরু হয়ে গেল শত্রু খোঁজা।

মনোজ, এই লড়াকু দ্বিশতরানের পরেও কয়েকটা অপ্রিয় কথা শুনে রাখুন। ব্যাট হাতে রান পেয়েছেন, তার মানে এটা প্রমাণ হল না যে, নেতৃত্বে আপনি অপরিহার্য। বরং, উল্টোটাই আরও বেশি করে ফুটে উঠল। যেভাবে নিন্দুক খুঁজতে নেমে পড়লেন, তার থেকে এটাই বোঝা যায়, ক্রিকেট থেকে আপনার মন অনেক দূরে। অধিনায়ক হয়ে ওঠার একটা অন্যতম শর্ত হল সহিষ্ণু হওয়া। চারপাশে কে কী বলছে, সেদিকে কান না দিয়ে দলকে মোটিভেট করা। কিন্তু আপনি কে কী বলছে, সেসব ভাবনাতেই মেতে রয়েছেন। সৌরভের পর বাংলার সবথেকে বড় প্রতিভা ছিলেন আপনি। আপনার নামের পাশে এতদিন অন্তত পঞ্চাশ টেস্ট, দেড়শোখানা ওয়ান ডে থাকার কথা। দেখুন ঋদ্ধিমান সাহাকে। কোনও হুঙ্কার নেই, আস্ফালন নেই, নিঃশব্দে ৩২ টেস্ট খেলে ফেলেছেন। টেস্টে তিন খানা সেঞ্চুরিও আছে। আর আপনি!‌ টেস্ট না খেলেই এত আস্ফালন। ওয়ান ডে খেলেছেন মাত্র তিনটি। তিন ম্যাচ মিলিয়ে রান মাত্র পনেরো। কেন জাতীয় দলের বৃত্ত থেকে ছিটকে গেলেন, একবারও ভেবে দেখেছেন!

প্রতিভা আপনারও কম ছিল না। ঘরোয়া ক্রিকেটা সাফল্য নেই, এমনটাও নয়। কিন্তু ওই যে, ফোকাস। একটাও টেস্ট খেললেন না, অথচ সৌরভ গাঙ্গুলিকে আজীবন শত্রু ভেবে এলেন। কোথায় সৌরভ আর কোথায় আপনি!‌ সৌরভ কোন দুঃখে আপনাকে শত্রু ভাবতে যাবেন!‌ এই সহজ সত্যিটা বোঝার চেষ্টা করুন।

জীবনের সেরা সময়কে হয়ত পেছনে ফেলে এসেছেন। আর হয়ত জাতীয় দলে ফেরা সম্ভব নয়। বা ফিরলেও বেশিদিন সেই দাপট দেখানো সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলার হয়ে এখনও অনেককিছুই দেওয়ার আছে। নাই বা রইল নেতৃত্ব, ব্যাট হাতে তো বড় ইনিংস খেলতে বাধা নেই!‌ শচীন তেন্ডুলকার বা রাহুল দ্রাবিড়কে কি কেউ নেতৃত্বের জন্য মনে রাখে?‌ মনে রাখে তাঁদের ব্যাটিংয়ের জন্য। এমনকী যিনি আপনাদের মেন্টর, সেই অরুণলাল কিন্তু রনজি জয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন না। কিন্তু রনজি জয়ের কথা উঠলেই সবার আগে এই নামটাই সবার মনে পড়ে। আপনিও ব্যাটেই মন দিন। নেতৃত্ব থাকল না গেল, কী আসে যায়!‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.