দুর্নীতির গ্রাহ্যতা:‌ এক সামাজিক সমস্যা

অম্লান রায়চৌধুরী

মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্ন জাগে, আর্থিক দুর্নীতি, যেটার বেশ বাড়বাড়ন্ত, কতটা সামাজিক দুর্নীতির আকার নিচ্ছে। সেটাই একটু দেখার ইচ্ছায় এই লেখা।
ছোটবেলার বেশ কিছু ঘটনা মনে পড়ল, ঘটনাগুলো শুনলে এই লেখাটার সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যাবে।
পাড়ার সামু চোর ছিল, আমাদেরই বন্ধু। প্রায়ই এ বাড়ির ফল, ফুল, এইসব চুরি করত। ধরা যে পড়ত না তা নয়। অনেক সময় আমরাও থাকতাম এই সমস্ত চুরির ব্যাপারে, কিন্তু এই ছোটো খাটো ব্যাপারে কেউ মাথা গলাত না। সামু বড় হল। আমাদের বন্ধু তো, কাজেই আমাদের সঙ্গেই বেড়ে উঠল। যতই ওই চুরির মধ্যে আমরাও থাকি না কেন, আমাদের ওই কাজগুলোকে সিম্পলি একটা ফান মনে হতো, কিন্তু সামুকে দেখতাম ওর আনন্দটা একটু অন্যরকমের, কৃতকার্যের আনন্দে কেমন যেন উন্মত্ততা দেখাতো। একটু অন্য ধাঁচের লাগত আমাদের। বেশি করে বুঝতে পারলাম, যেদিন ঘোষ বাবুদের বাড়ি থেকে কাচা আম প্রচুর পাড়া হল সবাই মিলে। ওখানে বসেই অনেকগুলো খাওয়াও হল, বাদবাকিগুলো সামু নিয়ে গেল বাজারে বিক্রি করতে। আমরা পরে জানলাম, ফিরে এসে আমাদের টাকা দেখাল।

বিষয়টা আমাকে নাড়া দিয়েছিলো সেই সময়। আমার কাছে এই ব্যাপারটার প্রতি আর আনন্দ রইল না, সামুও যে ইনহেরেন্টলি এক চৌর্য্য মনোবৃত্তি যাপিত করে বুঝতে পারলাম – না হলে ও চুরির মাল বিক্রি করে টাকা রোজগার করত না।

corruption1

ওদের পরিবারের অবস্থা যথেষ্ট ভাল ও ওরা শিক্ষায় ও দীক্ষায় বেশ এগিয়ে অনেকের চেয়ে। সামুও ভাল ছাত্র আমাদের তুলনায়। এই প্যারামিটার গুলো কোনও কাজেই লাগল না বা লাগান সম্ভব নয়, কারণ, মানসিকতায় দুর্নীতির বেসিকসটা দানা বেঁধে গেছে। আর্থিক আয়ের আনন্দটাও আছে, একেবারে পরিপূরক, পুরোপুরি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠার পক্ষে। তবুও সামু বন্ধু বলে, বিষয়টাকে মনে করেছি হয়ত ঠিক হয়ে যাবে এবং ওই বিষয়ে ওকে বোঝাতামও। তাই একটা বিশ্বাস ছিল। কিন্তু ঘটল এক ঘটনা। পূজোর ছুটিতে সুজয়দা আমাদের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে চলে গেল। সব দেখবার দায়িত্ব দিয়ে গেল আমার ওপর। সবার সে কি খুশী, আমি হলাম গিয়ে গুরু, সবার একটা জায়গা হল মাল খাওয়ার, আর কোনও চিন্তা নেই। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম, কোথায় এদিক ওদিক ঘোরা, সবার সন্দেহ। এখানে নিরিবিলি জায়গা, কেউ ঝামেলা করবে না। সামুও সাথী। চলল, কাটল পূজোটা আনন্দেই। সুজয়দারা ফিরে এল, চাবি দিয়েও দিলাম ।

হঠাৎ একদিন সুজয়দা আমাকে ডাকল। বলে, কী রে, আমার লক্ষ্মীর ঘটটা পাওয়া যাচ্ছে না, ওতে অনেক টাকা ছিল, বহুদিন ধরে জমা হওয়া। আমি একটু আশ্চর্য হলাম প্রথমে, কারন লক্ষ্মীর ঘটটা ছিল ছাদের সিঁড়িতে ওঠার পাশের একটা ছোট্ট পুজোর ঘরে। খোলা কিন্তু ওখানে কোনও আমাদের দরকারি জিনিস ছিল না যে যেতে হতে পারে। কাজেই কারুর না যাওয়ারই সম্ভাবনা।

লক্ষ্মীর ঘটের দিকে কেউ যায়নি, যাওয়ার কোনও প্রয়োজনও হয়নি, তাহলে নিল কে, নিশ্চয়ই সে জানতো বা ওটা নেওয়ার জন্যইও ওখানে গেছে। মনে তো পড়ছে না কিছুই – ওই রাতের হল্লার মধ্যে।

সামু ছাড়া কেউ না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ডাকা হল সামুকে, স্বীকার করল, সুজয়দাকে জানানো হল।

ভদ্রবাড়ির ছেলে, আমাদের বন্ধু বলে পাড়ার মানুষ বা সুজয়দা তেমন কিছু বলল না, কিন্তু আমার মাথাটা হেঁট হয়ে গেল, মনে হল আমরা সামাজিকতার ভান করি, সামাজিকতাই বুঝি না, কেমনভাবে একটা দুর্নীতির প্রভাব সারা পাড়াতে পড়ল সেটা দেখা যেত বেশ কয়েকদিন ধরেই। সবাই সামুকে দেখলে কেমনভাবে তাকাতো। এটাও এক ধরনের কায়দা, যেখানে মানুষটাকে আলাদা করে দেওয়া সমাজের মূলস্রোত থেকে, অথচ কোনও প্রত্যক্ষ্য আঘাত না এনে।

তখন এ গুলো ছিল সমাজের ভিতরেই, আমরা দেখেছি, শাস্তির রকমফের হত, বিভিন্নভাবে দুর্নীতিকে আইডেন্টিফাই করা হত। শাস্তিও সেইরকমই ভাগ করা হত।

এখন এই বয়সে এসে এই বর্তমান সমাজে যদি তাকাই দেখতে পাই অনেক দুর্নীতি বা বেশ কিছু অন্যায়কে আমরা এমনভাবে মেনে নিয়েছি, ফলে প্রশ্রয় পেয়েছে বা কোনও প্রশ্ন না করায় বেড়ে গেছে। সেটাকেও সহ্যসীমার মধ্যে নিয়ে নিচ্ছি ।
যেমন রোজই দেখি, অটো, গড়িয়া থেকে যাদবপুরে সরাসরি যাবে না। ভেঙ্গে যাবে । এখান থেকে ফাঁকা গেলেও লোককে নেবে না। ওদের ইচ্ছামতো রুটটা–‌কে ভাঙ্গবে, যদিও পারমিট এ লেখা আছে – গড়িয়া টু গোলপার্ক, কিন্তু ভাঙবে কমপক্ষে – তিনবার, বেশি লাভের আশায়। অর্থনৈতিক লাভের জন্য এতগুলো মানুষকে অহরহ অসুবিধার মধ্যে ফেলা।

corruption2

এভাবেই অসংখ্য দুর্নীতি যেগুলো আমরা রোজ দেখি, এবং সামাজিকভাবে মান্যতা দিই, যেমন যেখানে সেখানে বাস দাঁড়ানো, আমিই হয়ত নিজে থেকেই বাসকে থামাই, নেমে পড়ি একেবারে বাড়ির কাছে, কিন্তু যেই অন্য কেউ নামল বলে উঠি, বাসটা কি সব জায়গায় দাঁড়ানোর জন্য?‌ এভাবেই সামাজিক মান্যতা দিয়ে ফেললাম নিজের স্বার্থপরতার জন্য, নিজের অন্যায়টাকে ও তার থেকে লাভটাকে কেবল মাত্র নিজেরই স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য। সর্বজনীনতা দিতে পারা গেল না একটা অন্যায়কে। সবার সামনে তুলে ধরা গেল না। হয়ত এতদিনে বন্ধ হয়ে যেত। পারা যায়নি এরকম অজস্র জিনিস পাওয়া হয়নি আমাদের। নিজেদের অকর্মন্যতা ও আত্মস্বার্থের ডঙ্কা নিয়ে ব্যস্ত থাকার দৌলতে।

এখানে প্রতিটি দুর্নীতিকেই যদি দেখা যায় ভালোভাবে, তাহলে দেখা যাবে প্রত্যেকটাতেই অর্থনৈতিক লাভের সঙ্গে সঙ্গে একটা সামাজিক শূন্যতারও সৃষ্টি হচ্ছে, যেটাই একটা ক্রাইসিস – অসুবিধা, আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবার জন্যই। কেমন যেন একটা সয়ে যাওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, নিয়ম হয়ে উঠছে।

বয়স্ক লোকটা জানেন, সামনে যে ফাঁকা অটোটা যাবে, সেটা ওনাকে নেবে না, কারণ ওটা যাদবপুরের লোককেই খালি নেবে, উনি তো যাবেন গাঙ্গুলি বাগান, তাই নেবে না। তাই হেঁটে যেতে হবে মোড়ে, লাইন দিতে হবে, ওখানে অবশ্য লাইন দিলেই জায়গা মতো পৌঁছনোর ছাড়পত্র পাওয়া যায়। কিন্তু ওই অটোরা কারা – যারা বয়স্ক লোকটিকে নিল না। এদের নিয়ন্ত্রক কারা, এদের কোনও পরিচয়পত্র আছে কি, কিছুই জানা নেই। প্রশাসনও ব্যস্ত কেবল দলীয় ফান্ডের চাঁদা আদায়ের জন্য। পরিচালনায় ত্রুটি কে দেখবে?‌ দুর্নীতির আশ্রয় যে সমাজকে ধাক্কা মারছে, কে বুঝবে। সমাজ যে হারাচ্ছে ন্যূনতম সামাজিক সুবিধা কিছু দুর্নীতি পরায়ণ মানুষের জন্য, কে বুঝবে?‌

নব্য ভারত কেমনভাবে যেন আস্তে আস্তে দুর্নীতির সঙ্গে সহনীয় হয়ে উঠছে , ধরেই যেন নেওয়া হচ্ছে যে উন্নয়ন, বিকাশ, অগ্রগতি যেমন চলতে থাকবে, তেমনই শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে দুর্নীতিরও, নইলে বিজয় মালিয়ার দেশ ত্যাগ নিয়ে এত বিস্তর তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার পরেও আবার ঠিক সেই একই ভাবে নীরব মোদি ও চোকসির এই আচরণ এবং আর্থিক শোষণ সম্ভব হল কী করে।

ব্যাঙ্কের নিজস্ব কোনও আলো নেই, হয় সরকার এবং হয় গ্রাহক – এরাই ব্যাঙ্কের আলো। এই দুই প্রকারের আলোই জোগান দেয় আপামর জনগণ তেমনই ব্যাঙ্কের যা কিছু নিজস্ব টাকা – বলে বলা হয়, তা আসলে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়, সম্বল, সুরাহার কড়ি। নীরব মোদীরা যখন ব্যাঙ্কের টাকা লুটপাট করে চম্পট দেয়, তখন ব্যাঙ্ক শুধু পথে বসে না, রাতারাতি হতভাগ্যে পরিণত হয় হাজার হাজার আমানাতকারী। নীরব মোদীরা এই বিচারে সামাজিক দোষী , নৈতিক অপরাধের থেকে কোনও অংশে কম নয়।

জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, সামাজিক অপরাধ ছাড়া কী নাম দেওয়া যায় এদের। দুর্নীতি ও অসততা বা জেনেশুনে নিজের আর্থিক লাভের অসদুপায় অবলম্বনে – সব গুলোকেই প্রায় একই কাঠামোতে দাঁড় করানো যায় । প্রত্যেকটি কাজের জন্যই সমাজের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা নির্দেশ করে। আমরা যেন দেখতে পাচ্ছি ধীরে ধীরে এই সমস্ত কাজগুলো কেমন ভাবে যেন জনগ্রাহ্য হয়ে উঠছে। এই জনগ্রাহ্যতার বিষয়টা নিয়ে ভাবলে দেখা যায় – যতই গ্রাহ্যতার সীমা বাড়ে, মানুষ ততই কম প্রতিবাদ করে, কম বিক্ষোভ দেখায়। নিজেদের গুটিয়ে রাখে একেবারেই নিজের মধ্যে, সমাজে বাস করে শুধু বাস করার জন্য, বাসযোগ্য কিনা সেটা দেখবার প্রয়োজন বোধ করে না।

এদের সৃষ্টি করা হয় – শাসকদের কাজই এই শ্রেণীটাকে শক্ত কর, পোক্ত করো , কাজেই এদেরকেই দুর্নীতির লাইসেন্সটা দাও। ইনসেন্টিভ হিসাবে, এরাই তো মিছিল আটকাবে।
আজকের নীরব মোদী বা চোকসি বা বিজয়মালিয়া এই ভাবের প্রতিবিম্ব নয় হলপ করে কি আমরা বলতে পারি‌!‌
জানি প্রমান নিয়ে খচখচানি চলবে, কিন্তু সমাজ তো চিনবেই অসামাজিক মানুষকে সে যে চেহারাতেই আসুক না কেন, যে ভাবনাতেই বিরাজ করুক না কেন, যে রাজনীতির আশ্রয়েই থাকুক না কেন ।

ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে দেশের পি এস উ–‌র চেয়ারম্যানের প্রত্যেকটা হ্যাঁ অথবা না – ঠিক করে দেয় দল, শাসক দল, সেখানে এত বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতি চেয়ারম্যানের – ইনভলবমেন্ট ছাড়া হয়নি। তাহলে কার বা কাদের নির্দেশে?‌ জানি, সাপ বেরিয়ে যাবে। যে কারণে আজ পর্যন্ত বিজয় মালিয়াকে ফিরিয়ে আনা গেল না, তার বিরুদ্ধে চার্জ শিট তৈরি করা গেল না।

আমরা কোথায় – খালি স্তম্ভিত হই চোরের মার বড় গলা দেখে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.