বাঙালির হাত ধরেই সেই দাপট ফিরে আসুক

সুগত রায়মজুমদার

‌প্রথমেই অভিনন্দন জানাই এবারের কলকাতা লিগ জয়ী মোহনবাগানকে। গত ৮ বছর ধরে এই ঘরোয়া লিগ মোহনবাগানের কাছে অধরাই থেকেছে। গত বছর লিগ জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেও গোলপার্থক্যে পিছিয়ে থেকে লিগ জয় থেকে ছিটকে গিয়েছিল মোহনবাগান। এ বছর কিন্তু মোহনবাগান পজিটিভ দল তৈরি করে প্রথম থেকেই দক্ষ ২ বিদেশি ও বাঙালি ফুটবলারদের ওপর আস্থা রেখে কী সুন্দর ফুটবলটাই না উপহার দিয়েছে।
পাশাপাশি ইস্টবেঙ্গল দলটি ঠিকমতো তৈরিই করতে পারেনি। কর্তারা বিদেশি বিশ্বকাপার এনে চমক দিতে চেয়েছিলেন। কর্তারা কতটা খেলাটা বোঝেন, সেটাতেও সংশয় আছে। যদিও বিশ্বকাপার খুবই দক্ষ। এ নিয়ে প্রশ্নই ওঠে না। একটা দলে যদি সমন্বয়ের অভাব থাকে, তা হলে সেই দলের একজন ভাল খেলোয়াড় থেকেও সেই ফল দিতে পারেন না। যেমন মেসি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হয়েও সেই ফল দিতে পারেননি আর্জেন্টিনাকে। ফুটবলটা দলগত খেলা। সেখানেই সবারই অবদান প্রয়োজন। কোচ সুভাষ ভৌমিক অতীতে বেশ কিছু ট্রফি দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলকে। তিনি ইস্টবেঙ্গলকে দিয়েছিলেন কলকাতা লিগ, জাতীয় লিগ, আশিয়ান কাপ। সেজন্যই তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া। দল ভাল না হলে কারও কিছু করার নেই। তখন ইস্টবেঙ্গলে ওকোরো, ডগলাস, মুসা, জুনিয়রদের মতো বিদেশি ছিলেন। বাইচুং তো ছিলেনই, সঙ্গে দীপক মণ্ডল, মহেশ গাউলি, আলভিটো, সুরকুমারের মতো ভিনরাজ্যের খেলোয়াড় ছিলেন। আর বাঙালিদের মধ্যেও সন্দীপ, দেবজিৎ, চন্দনের মতো ফুটবলার। সবমিলিয়ে দুরন্ত কম্বিনেশন। সেজন্যই তখন সম্ভব হয়েছিল শিখরে ওঠা।

mohun bagan11
কিন্তু এ বছর ইস্টবেঙ্গল দল ছিল স্ট্রাইকারহীন। একটা দল যতই ভাল হোক, সেই দলে যদি কোনও ভাল মানের স্ট্রাইকার না থাকে, সেই দলের লিগ জয় তো অধরাই থাকবে। কোচের বিশেষ কিছু করার নেই। কর্তারা শুধু ছোট উচ্চতার কিছু মিজোরামের খেলোয়াড় এনে হাফ লাইনে ভিড় বাড়িয়েছিলেন। তাতে লিগ জয় করা যায় না, এটা কর্তারা বুঝতেও পারলেন না। যাদের হেডে একেবারে দক্ষতাই নেই। আধুনিক ফুটবলে হেড ছাড়া কোনও সেটপিস মুভমেন্ট করা যায় না। সেটা মোহনকর্তারা বুঝেছিলেন। সেজন্যই ২ জন দক্ষ স্ট্রাইকারকে দলে নিয়েছিলেন। ছোট দলগুলিও দক্ষ স্ট্রাইকার রেখেছিল। সেজন্যই ইস্টবেঙ্গল ছোট দলগুলির কাছেও হেরেছে।
এখন কলকাতার দলগুলি চালান ফুটবল না বোঝা কিছু কর্পোরেট কর্তারা। অতীতে বড় ও ছোট দলগুলিকে চালাতেন দলেরই প্রাক্তন ফুটবলাররা। শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামী, সুনীল ভট্টাচার্যরা। এ ছাড়াও ছিলেন ধীরেন দে, জ্যোতিষ গুহ, নৃপেন দাসের মতো ফুটবলমনস্ক কিছু বাঙালি কর্মকর্তারা। বিশ্বকাপে স্পেন দলের খেলা দেখেও তাঁরা উপলব্ধি করেননি!‌ স্পেন দলে ছিল শুধু মিডফিল্ডারদের ভিড়। কোনও ভাল স্ট্রাইকার ছিল না। সেজন্যই স্পেন বিশ্বকাপে ফল পায়নি। জার্মানিও তথৈবচ। গতবারের ফাইনালের গোলদাতা গোৎজের মতো খেলোয়াড়কে বাদ দিয়ে যা পরিণতি হয়, তাই হয়েছে। পরিবর্তে কোচ লো মুলার, গোমেজের মতো বয়স্ক খেলোয়াড়দের সুযোগ দিয়ে দলকে দুর্বলতর করে ফেলেছিলেন। তাদেরকে দেখেও তো ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের উপলব্ধি করা উচিত ছিল। দলে ভাল স্ট্রাইকার ছাড়া দলকে ভাল ফল দেওয়া মুশকিল। ইস্টবেঙ্গলেরও এই হাল হল স্ট্রাইকারের অভাবে। প্রমাণ হল, ভাল স্ট্রাইকার ছাড়া দল গড়লে তাতে সাফল্য আসবে না।

mohun bagan10

এবার আসি বাঙালি ফুটবলারদের নিয়ে। এ বছর বাঙালি ফুটবলাররা দেখাল, কলকাতার দলগুলি বাঙালি ফুটবলার ছাড়া চলবে না। মোহনবাগান দল বিদেশির পাশাপাশি বেশ কিছু দক্ষ বাঙালি ফুটবলারকে দলে রেখে খেলার মান অনেক উঁচুতে নিয়ে গেল। মোহনবাগানের বেশ কিছু খেলোয়াড় এ বছর অনেকের চোখে পড়েছে। তাঁরা হয়ত এ বছর আই এস এলেও খেলার সুযোগ পাবেন। প্রথমেই বলতে হয় পিণ্টু মাহাতো, সৌরভ দাস, আজহারউদ্দিন মল্লিকদের কথা। তাঁরা লিগে নিজেদের সম্পূর্ণটা উজাড় করে দিয়েছেন। এ ছাড়া ভিন রাজ্যেরও আম্বেদকার, শিলটনরাও নজর কেড়েছেন। বাঙালি ফুটবলার, ভিনরাজ্যের খেলোয়াড় এবং বিদেশি খেলোয়াড়দের সমন্বয়ই মোহনবাগানকে লিগ জয়ের পথ সুগম করেছে। আর এই কাজটা মসৃণভাবে পরিচালনা করেছেন কোচ শঙ্করলাল চক্রবর্তী। জুনিয়র খেলোয়াড়দের উঠে আসার পেছনে তাঁর অবদান অনেকটাই। পাশাপাশি দল যখন সুসংগঠিত, তখনই ইস্টবেঙ্গল কিংশুক ও কৌশিকের মতো খেলোয়াড়কে বাদ দিয়ে অ্যাকোস্তাকে হঠাৎ দলে ঢুকিয়ে দলের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। দলটি হঠাৎই ছন্দ হারিয়ে ফেলে।
এ বছরে কলকাতা লিগে এত ভাল বাঙালি ফুটবলারের উত্থান। এটা শুভ লক্ষ্মণ। একঝাঁক বাঙালির উত্থান পরবর্তীকালে কলকাতার দলগুলিকে পুনরায় জাগিয়ে তুলবে। সব দলগুলিরই উচিত, এঁদেরকে ধরে রাখা ও পরিচর্যা করা। কলকাতা লিগে ছোট দলগুলিও খুব সুন্দর ফুটবল উপহার দিয়েছে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে কেউ কেউ নজর কেড়েছেন। গোয়া নিজের রাজ্যের খেলোয়াড়দের সুযোগ দিয়ে ভাল ফল পেয়েছিল আই লিগে। তখন কলকাতা ফুটবল হারিয়ে গিয়েছিল তৃতীয় শ্রেণির কিছু বিদেশি ও ভিনরাজ্যের মাঝারিমানের খেলোয়াড়দের সুযোগ দিয়ে। পুনরায় বাংলার সুযোগ এসেছে হৃত গৌরব উদ্ধার করার।
ফুটবলটা বাঙালির মজ্জায় যুগ যুগ ধরে। কত বড় বড় ফুটবলার উপহার দিয়েছে এই বাংলা। এই বাংলায় খেলে সমৃদ্ধি পেয়েছিলেন পি কে ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামী, তুলসীদাস বলরাম, আমেদ খান, সালে, বেঙ্কটেশ, ধনরাজ, সাত্তার, কাজল মুখার্জি, সুধীর কর্মকার, সমরেশ চৌধুরি, সুভাষ ভৌমিক, হাবিব, নঈম, আকবর, অশোকলাল ব্যানার্জি, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, স্বপন সেনগুপ্ত, প্রসূন ব্যানার্জি, সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রশান্ত ব্যানার্জি, কৃশানু দে, বাইচুং, চিমা, মজিদ, জামশিদ, ব্যারেটোরা। এই খেলোয়াড়রা বাংলায় খেলে নিজেদের গর্বিত মনে করেন। এ বছর সেই ঋত গৌরব পুনরুদ্ধারের পালা। বাংলার ফুটবল আবার জাগছে। সর্বভারতীয় ফুটবলেও সেই দাপট ফিরে আসুক, এবং তা বাঙালিদের হাত ধরেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.