মধুজা মুখোপাধ্যায়, নিউইয়র্ক
অফিসে জানলার ধারে ডেস্কে কম্পিউটার স্ক্রিনে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে করতে হঠাৎ মোবাইলে ‘ টিং’ করে একটা শব্দে স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারের তরফ থেকে ওয়েদার অ্যালার্ট। দুপুর থেকে বিকেল সাতটা পর্যন্ত ভারী বর্ষণের সম্ভবনা, তাই শেল্টার এ থাকার অনুরোধ ! বিকেল সাতটা বলছি, কারণ এখন নিউইয়র্কে রাত ন’টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে। কাঁচের জানলার ওপারে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ। চোখে পড়ল ঘন কালো মেঘ আমার ডেস্কের দিকে কুন্ডলী পাকিয়ে এগিয়ে আসছে শ্লথ গতিতে। আর তো ডেস্কে বসে থাকা যায় না। কফির মগ হাতে নিয়ে উঠে পড়লাম। গন্তব্য কাঁচের বারান্দা। মেঘটা আসছে পূবদিক থেকে। অর্থাৎ দেশের দিক থেকে । তার মানে, মেঘদূত দেশের বার্তা নিয়ে আসছে। মনে মনে হাসলাম। আমার হোমসিক মন শেষে মেঘকেও রেহাই দিল না !
এদেশে একটা কথা প্রচলিত “April showers bring May flowers”! অর্থাৎ এপ্রিলে বৃষ্টি পড়লে মে মাসে গাছপালা ফুলে-ফলে ভরে উঠবে। এপ্রিল থেকে বৃষ্টি শুরু হয় ঠিকই, কিন্তু সে চলে যখন তখন, সেপ্টেম্বর মাসে পর্যন্ত বৃষ্টি হতে দেখেছি। তাই নিউয়র্কের সঠিক বর্ষাকাল কখন সেটা বলা বেশ কঠিন। এখানে বলা যেতে পারে, এক্সট্রিম ক্লাইমেট, গরম ও ঠান্ডার দুই ভীষণ রূপ, তাই আমার কলকাতার সাথে বেশ মিল পাই !
কাঁচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেঘ দেখার ব্যাপারটা অনেকটা “জলে নামব চুল ভেজাবো না” র মতো ! মেঘ আমাকে ঘিরে ফেলবে চারিদিক থেকে, অথচ ছুঁতেও পারবে না। এ তো তবে খুব দুঃখের ঘটনা। মেঘদূত বলে কথা, অথচ সে যদি তোমাকে ছুঁতে না-ই পারল, তাহলে বিদেশে বসে দেশের গন্ধ পাবে কেমন করে ? ভালো করে লক্ষ্ করলাম প্রকান্ড মেঘের কুণ্ডলীর তলার দিকটা ঘন কালো রং।
মেঘের ওজনও বেশ ভারী, তার মানে মেঘদূত প্রচুর গল্প জমিয়ে এনেছে আজ। গল্পগুলো সেই ছোট্ট বেলা থেকে শুরু করলে কেমন হতে পারে ? রাসবিহারী এভেন্যুর রথের মেলার পাখির খাঁচা, জানলায় বসে ভিজে কাকের অপরাধী মুখ, স্কুলে রেইনি ডে, প্রথম বৃষ্টির জল পড়ে মাটি থেকে অদ্ভুত সবুজ রঙের গন্ধ, মামাবাড়ির জানলা দিয়ে বিশাল কদমডালের দোল খাওয়া দেখা, ঝোড়ো হাওয়ায় মাটিতে পড়ে থাকা কদম ফুল কুড়োতে যাওয়া, ডাঁসা পেয়ারায় কামড় দেওয়ার কম্পিটিশন, দেশের বাড়ির আম গাছের পাতার ফাঁকে আলো-আঁধারি, লোডশেডিংয়ে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে অঙ্ক কষা , রেইনকোটের রং বাছাই ,ঘরের দড়িতে কাপড় শুকোতে দেওয়া , বাজ পড়লে পাড়ায় পাড়ায় শাঁখে এক জোটে ফুঁ দিয়ে শাঁখ মল্লার রাগ, কড়কড় বাজ পড়ার শব্দে বড়দের সাবধান বাণী “আকাশে শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই হচ্ছে, শান্ত হয়ে বসো “, কাদা মাখা জুতো পরে বাড়ির সামনে পায়ের ছাপ ফেলা এরকম আরও কত কি ! ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে মেঘের কুণ্ডলীর মধ্যে দিয়ে একখানি আলোর মালা দ্রুত গতিতে মেঘের এপার থেকে ওপার যাত্রা করল। বজ্রমাণিকের মালা খানি দেখে মনে হল অভিসারিকা শ্রীরাধিকা শ্রীকৃষ্ণের জন্য গাঁথা মালা নিয়ে অজানার দিকে এগিয়ে চলেছে। আকাশ ততক্ষনে গাঢ় নীল, যেন শ্রীরাধিকার নীলাম্বরী শাড়ির আঁচলখানি নিউইয়র্কের আকাশ জুড়ে আপন খেয়ালে উড়ছে !
বেশ চলছিল মেঘের কোলে ছোটবেলার ছায়াছবি দেখা ! হঠাৎ কঠিন বাস্তবে ফিরতে হল। এবার ডেস্কে ফেরার পালা। নাহ, আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন না, শুনেছি এবছর আষাঢ়ের প্রথম দিনে মনমতো বৃষ্টি পায়নি আমার দেশের মানুষগুলো । তবে কি সব পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত? পাল্টে যাচ্ছে পুরোনো সব মিথ ? এই মেঘ গুলো পশ্চিমের পালা মিটিয়ে যদি আবার পূবদিকে যাত্রা করে তবে কি নিউইয়র্কের এই বৃষ্টি ভেজা দুপুর নিয়ে যাবে সাথে করে আমার দেশে ? নিশ্চয়ই যাবে, তবে আর মেঘদূত নাম কেন? ডেস্কে ফেরার আগে দুচোখ ভরে দেখে নিলাম কালো মেঘের ঘনঘটা। মাথার মধ্যে কবিগুরুর “মেঘদূত” ঝলকানি দিতে দিতে বলে গেল “মিলনের প্রথম দিনে বাঁশি কী বলেছিল। সে বলেছিল, সেই মানুষ আমার কাছে এল যে মানুষ আমার দূরের।” মোবাইলে আমার অজান্তেই কখন পান্ডোরা রেডিও চ্যানেলে উস্তাদ আমজাদ আলি খান মিঞা মল্লারের ঝড় তুলেছেন!
(ছবি সৌজন্য : দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় )