ভোটকর্মীর ডায়েরি
শান্তনু বটব্যাল
আমি পেশায় একজন শিক্ষক। নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক পরিচয় নেই। কোনও দলের অন্ধ সমর্থক নই। আবার অন্ধ বিরোধীও নই।
বর্তমান সরকারের কিছু কিছু কাজ ভাল লাগে। সেগুলো প্রশংসা করতে কোনও সংশয় নেই। আবার অনেক কাজ খারাপ লাগে। কোথাও কোথাও সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও স্থানীয় লোকেদের জন্য সেটা রূপায়ণ হয় না।
রাজকুমার রায়ের মৃত্যুর বিষয়ে বেঙ্গল টাইমসে নিজের মনোভাব তুলে ধরতে চাই। এটিকে নিয়েও রাজনীতি চলছে। আসল কারণ অনেক পেছনে চলে যাচ্ছে। বিকাশ ভট্টাচার্যকে ধন্যবাদ, তিনি কলকাতা থেকে রায়গঞ্জে এসে ধৃত শিক্ষকদের জামিনের ব্যবস্থা করেছেন। আগামী দিনেও পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
রাজকুমার সত্যিই খুন হয়েছেন নাকি আত্মহত্যা করেছেন, এটা আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়। যদি তিনি আত্মহত্যাও করে থাকেন, এটুকু অনুমান করতে পারি, সেটা পারিবারিক কারণে করেননি। ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে আমাদের সবাইকেই কম–বেশি হেনস্থা হতে হয়েছে। চোখের সামনে দেখেছি, ছাপ্পা হচ্ছে। কিচ্ছু করতে পারিনি। উঁচু তলার অফিসারদের ভূমিকাও বেশ লজ্জা জনক। তাঁরা আমাদের পাশে দাঁড়ানোর থেকেও ছাপ্পাবাজদের পাশে দাঁড়াতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এবং এটা কোনও ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। অধিকাংশ জেলাতে এটাই সার্বিক চিত্র। কোনও কোনও পোলিং স্টাফকে তো শারীরিকভাবে হেনস্থাও করা হয়েছে। আমারই মনে হয়েছিল, বাড়ি ফিরে কী জবাব দেব। বাড়িতে গিয়ে গিন্নিকে বলব সবাই ছাপ্পা মেরে গেছে, আমরা পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম? আমাদের অধিকাংশ শিক্ষককেই এই গ্লানি নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। কোনও সংবেদনশীল মানুষ যদি এই গ্লানি সহ্য করতে না পেরে উল্টো পাল্টা কিছু করে বসেন, সেটাও অস্বাভাবিক নয়। এমনকী যাঁরা শিক্ষা সেলের সদস্য, যাঁরা শাসকদলের ঘোষিত সমর্থক, তাঁরাও রেহাই পাননি। তাঁদেরও বুথে বুথে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। কোথাও কোথাও পোলিং স্টাফেরা অত্যুৎসাহী হয়ে নিজেরাই ছাপ্পা মেরেছেন। ভাবতেও অবাক লাগছে, আমরা কোন পথে চলেছি? বাহাত্তরের কথা শুনেছি। কিন্তু তখনও আমার জন্ম হয়নি। কিন্তু যতদূর মনে হয়, এমন লজ্জাজনক নির্বাচন এর আগে বাংলায় হয়নি।
কোথাও কোনও সুবিচার পাওয়া যাচ্ছে না। বালুরঘাটে শুনলাম, বিডিও নাকি ভোটকর্মীকে মারধর করেছেন। ডিএম–কে জানিয়েও ফল হচ্ছে না। এরা বোধ হয় আরও বেশি অসহায়। আগে আই এ এস, ডব্লু বি সি এস দেখলে সমীহ হত। এখন করুণা হয়। জানি না, এঁরা বাড়িতে ফিরে গিয়ে বউকে কোন বীরত্বের গল্প শোনান।
হ্যাঁ, এরকম একটা নির্বাচন হল, যেখানে প্রায় নব্বই শতাংশ ভোট কর্মী চূড়ান্ত গ্লানি আর অপমান নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। এমন একটা পরিবেশ এই সরকার উপহার দিল। যা অনেক ভাল কাজকেও ম্লান করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
(ভোটকর্মীর ডায়েরি। এটি ওপেন ফোরামের লেখা। মতামত ব্যক্তিগত। চাইলে আপনি নিজের অভিজ্ঞতা মেলে ধরতে পারেন। )