শাড়ি দেখেই ঠিক চিনে ফেলেছিলেন পেলে

‌স্বরূপ গোস্বামী

কতটা বয়স হলে তাঁকে বৃদ্ধ বলা যায়? আমাদের চারপাশে তাকালে উত্তরটা বড্ড ঝাপসা মনে হয়। কেউ ষাটে রিটায়ার করার পরেই গৃহবন্দী। সত্তর পেরোনো কেউ পাড়ার দোকানে গেলেও বাড়ির লোকের সে কী টেনশন! ফিরতে একটু দেরী হলেই কত কথা শুনতে হয়। বাধ্য হয়ে ঘরে গিন্নির পাশে বসে সিরিয়াল দেখতে হয়।

কিন্তু তিনি এমন ছকে বাঁধা মানুষ নন। তাই এই পঁচাশিতেও তিনি পাড়ি দিচ্ছেন সুদূর রাশিয়ায়। আগে বলা হত, সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা জিতলে সেটা কোনও খবর নয়। বাংলা জিতবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। বরং বাংলা হারলে সেটা একটা খবর। পঁচাশির চৌকাঠ পেরিয়ে আসা পান্নালাল চ্যাটার্জির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা বোধ হয় তেমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বিশ্বকাপ যাচ্ছেন, এটা বোধ হয় আর তেমন খবর নয়। বরং, না গেলে বলা হত, এবার তিনি যাচ্ছেন না।

pannalal1

আসলে, নিছক এবার যাচ্ছেন, এমন তো নয়। বিশ্বকাপের নেশাটা চেপেছে সেই ১৯৮২ থেকে। তারপর ছিয়াশির মেক্সিকো, নব্বইয়ের ইতালি থেকে শুরু করে ২০১০ এর দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে ২০১৪–‌র ব্রাজিল। কোনও বিশ্বকাপেই বাদ নেই। বিশ্বকাপ হলেই তিনি হাজির। সঙ্গে স্ত্রী চৈতালি চট্টোপাধ্যায়। কর্তা–গিন্নি এখানে ওখানে বেড়াতে যান, এমন ঘটনা অনেক পরিবারেই দেখা যায়। কিন্তু এই কর্তা গিন্নির শখ ও ভালবাসা বলতে একটিই, সেটা হল চার বছর পর পর বিশ্বকাপ দর্শন।

মনে হতে পারে, নিশ্চয় অনেক টাকা বা সঞ্চয় আছে! একেবারেই উল্টো। আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবার যেমন, পান্নালালবাবুর পরিবারও তার থেকে আলাদা কিছু নয়। নিজে চাকরি করতেন খিদিরপুর ডকে। কুড়ি বছরেরও আগে রিটায়ার করেছেন। সম্বল বলতে নিজের পেনশনটুকু। আর স্ত্রীর একটা ছোট কাপড়ের দোকান আছে। এই দুই মিলিয়ে কোনওরকমে চলে যায়। প্রতি মাসে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে রাখেন, বিশ্বকাপ এলে সেই সঞ্চয় ভেঙে হাজির হয়ে যান এই দম্পতি।

হঠাৎ এমন শখ হল কী করে? পান্নালালবাবুর মুখেই শোনা যাক, ‘ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খুব ভালবাসতাম। আমার গিন্নিও তাই। প্রতিবছর সন্তোষ ট্রফি দেখতে যেতাম। কর্তা–গিন্নি দুজনেই যেতাম। বাংলা দলের ম্যানেজার হয়েও গেছি। যখন পনেরো–ষোল বছর যাওয়া হয়ে গেল, তখন একদিন বিশ্বনাথ দত্ত বললেন, বারবার সন্তোষ ট্রফিতে যাচ্ছো। একবার বিশ্বকাপ থেকে ঘুরে এসো। কিন্তু তার তো অনেক খরচ! বিশুদা বললেন, চলে যাও, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তাঁর এক বন্ধুকে বলে দিলেন। সেই বন্ধুর বাড়িতে থেকেই সেবার বিশ্বকাপ দেখেছিলাম।’

pannalal3

তারপর থেকেই নেশা ধরে গেল। সব শখ বিসর্জন দিয়ে একটু একটু করে টাকা জোগানো। চাইলে হয়ত গোটা পাঁচেক গাড়ি কিনতে পারতেন। খিদিরপুরের পুরানো বাড়িটা ছেড়ে হয়ত ঝাঁ চকচকে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যেতেই পারতেন। কিন্তু পান্নালালবাবুর কথায়, ‘হ্যাঁ, এসব করতেই পারতাম। এটাই তো সবাই করে। কিন্তু আমি যে অন্যরকম। তাই একটু একটু করে পয়সা বাঁচিয়ে যাই বিশ্বকাপে।’ এবারের টিকিট হাতে এসে গেছে। ফাইনাল দেখবেন না? পান্নালালবাবুর কথায়, ‘দেখতে পারলে তো ভাল হত। কিন্তু ফাইনালের টিকিট যে অনেক দাম। এতটা কুলিয়ে উঠতে পারব না। তাই আগেই ফিরে আসতে হবে। সব জায়গায় তো ঘুরতে পারব না। খরচ আছে, বয়সও তো বেড়েছে। এই শরীর নিয়ে কতটা পারব, কে জানে!‌ খেলা দেখাটাই তো শেষ কথা নয়। চারপাশের যে পরিবেশ, এটাই তো আসল। যে একবার দেখে এসেছে, সে এই নেশা ছাড়তে পারবে না। এর রোমাঞ্চই আলাদা।’

এতদিন বিশ্বকাপ দেখছেন। স্মরণীয় কোনও অভিজ্ঞতা? আসলে, অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এতকিছু রয়ে গেছে, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলবেন! মিসেস চ্যাটার্জির মুখে একটা অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাক, ‘ছিয়াশির বিশ্বকাপে পেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অনেক কথাও হয়েছিল। নব্বইয়ে ইতালিতে আমরা যে হোটেলে ছিলাম। তার পাশেই ছিলেন পেলে। সেবার দেখা করতে যেতেই আমার শাড়ি দেখে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। বললেন, আপনি এবারও এসেছেন! পেলের পাশে দাঁড়িয়ে সেবার ছবি তুলেছিলাম।’ সেই ছবিটাই টাঙানো আছে দেওয়ালে। কে বলতে পারে, এবার হয়ত আবার দেখা হয়ে যেতেই পারে। শাড়ি দেখে হয়ত আবার চিনে নিতেও পারেন। কে বলতে পারে, চ্যাটার্জি বাড়ির দেওয়ালে হয়ত আরও উজ্জ্বল কোনও ছবি দেখা যাবে।
***

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.