সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
ত্রিপুরার বিধানসভা ভোটে বিপুল সংখ্যক আসনে জয়লাভ করে বর্তমানে কেন্দ্রের শাসক দল বা বিজেপি এতটাই উল্লসিত যে, সেই পৈশাচিক উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ভোট গণনার দিনই ত্রিপুরাতে হাজার হাজার বামপন্থী কর্মী ও সমর্থকদের ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া বা অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এবং তাতেও সেই উগ্র ধর্মান্ধরা তৃপ্ত হয়নি। পরের দিনই ত্রিপুরার বিলোনিয়াতে রাশিয়া তথা সারা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক লেনিনের পূর্ণাবয়ব একটি প্রস্তরমূর্তি ধূলিসাৎ করে তারা প্রমাণ করল, বাস্তবিকই জাতীয়তাবাদের নামে গোটা দেশ জুড়ে এক ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে এই উদগ্র সাম্প্রদায়িক দল।
শুধু মহামতি লেনিনের মূর্তিই নয়,উপর্যুপরি তামিলনাড়ুতে পেরিয়ারের মূর্তি, উত্তরপ্রদেশের মেরঠে দেশের সংবিধান প্রণেতা ও বরেণ্য রাজনীতিবিদ ভীমরাও আম্বেদকরের মূর্তি এবং মধ্যপ্রদেশে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসের মূর্তিও ভাঙা হয়েছে। আজকের সংবাদপত্রেই আছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মূর্তি ভাঙার কথা। প্রতিবারই অভিযোগের তীর সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির দিকে।
আসলে বিগত চার বছর ধরেই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির যা কিছু গরিমাময়, তাকে নির্মূল করার এক ঘৃণ্য প্রয়াস চলছে। এর একটাই কারণ। দেশের সভ্যতাকে ধীরে ধীরে মধ্যযুগের দিকে নিয়ে যাওয়া। কোথাও বা প্রস্তরমূর্তির ওপর আঘাত আসছে তো কোথাও আবার যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল কণ্ঠকে রোধ করার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে এই ধর্মান্ধ ও মৌলবাদীর দল। বাস্তবিকই তা “চেতনার” মূলেই কুঠারাঘাত। বিগত বছরে প্রখ্যাত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে হত্যা করা বা বছর তিন আগে এম.এম.কালবুর্গী কে হত্যা করা বা নরেন্দ্র দাভোলকারকে হত্যা করা—এই যুক্তিবাদের কন্ঠরোধ করারই নামান্তর। আর ত্রিপুরায় এই “অপ্রত্যাশিত’ জয় পেয়েই এই উগ্র ভৈরব বাহিনী এবার দেশের সংস্কৃতিকেই বিনাশ করার মারণখেলায় মেতেছে। মহামতি লেনিন শুধু একটি দেশের নাগরিক নন, তিনি সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের প্রতিভু। সারা পৃথিবীতে যতদিন শোষণ থাকবে, যতদিন শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রাম থাকবে, যতদিন তারা দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে পুঁজ়িবাদী ও ধনতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে একজোটা হয়ে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাবে, ততদিন লেনিন থাকবেন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে, চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে। একটা মূর্তি ভেঙে তাকে শেষ করা সম্ভব নয়। তিনি সারা পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিভু। পুঁজিবাদী ধনতান্ত্রিক শক্তির লেনিনের প্রতি যতই আক্রোশ থাকুক না কেন, তিনি অমর। তেমনি ভারতবর্ষের সংবিধান প্রণেতা ভীমরাও আম্বেদকরও অনন্য ব্যক্তিত্ব তার সমাজচেতনায়। তিনি ভারতবর্ষের অখণ্ডতা রক্ষার্থে, তার সার্বভৌমত্বের স্বার্থে ভারতবর্ষকে একটি “ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক” রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন। তাই তিনি এই উদগ্র হিন্দুত্ববাদীদের রোষানলে পড়েছেন, মৃত্যুর এত বছর পরেও। তেমনি “অহিংসার মূর্ত প্রতীক” মহাত্মা গান্ধী বা রাষ্ট্রনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস বা এরাও আজ এই নরপশুদের রোষের বলি। বাঙালি কবি ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের রূপকার মধুসূদন দত্তও খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণেই আজ এদের চক্ষুশূল।
তাই একটাই প্রশ্ন। বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বদের প্রস্তরমূর্তি ভেঙে কি কোটি কোটি ভারতবাসীর চেতনা থেকে এঁদের নাম, যশ মুছে ফেলা সম্ভব? মৃত্যুর এত বছর পরেও এঁরা আপন প্রতিভার স্বীকৃতি লাভ করছেন সারা বিশ্বে। আগামী সভ্যতাও এদের দেখানো পথ ও মতেই চলবে। শুধু এই উগ্র ধর্মান্ধ, মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরা ইতিহাসের নির্মম পরিণতি অনুযায়ী একদিন জার্মানির হিটলার বা ইতালির মুসোলিনীর মত বিলীন হয়ে যাবে সভ্যতার অন্ধকারে।