ভাঙড়কে সিঙ্গুরের ঘটনার সঙ্গে মেলাবেন না

সুগত রায়মজুমদার
‌সম্প্রতি টিভিতে পশ্চিমবঙ্গের ভাঙড়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কিছু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শিল্পের পক্ষে ও বিপক্ষে এক আকর্ষণীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপি–‌র মুখপাত্রেরা। এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য এবিপি আনন্দকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এরকম আলোচনায় সাধারণ মানুষ বাস্তবটা বুঝতে পারেন এবং সঠিক পথটাই বেছে নিতে পারেন।
সকলেই জানেন, রাজ্য বা দেশকে উন্নত করতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন বিদ্যুতের। বিদ্যুৎ ছাড়া কোনও শিল্প হয় না। ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলি এজন্যই শিল্পে অগ্রগণ্য। আমাদের দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার দলগুলি চায় প্রথমে রাজনীতি। এই রাজনীতির জন্য যদি দেশে বা রাজ্যে শিল্প না হয় হোক। আমরা তো সরকারকে অপদস্থ করতে পারলাম। আমরা তো জয়ী হলাম!‌ এই হীন মানসিকতা আমরা যদি ঝেড়ে ফেলতে না পারি, তা হলে তো কোনও দিনই আমাদের রাজ্যে বা দেশে শিল্প হবে না। আর আমাদের রাজ্যের যুবক বা তরুণ–‌তরণীরা অন্য রাজ্যে বা অন্য কোনও দেশে চলে যেতে বাধ্য হবে রাজনীতির কিছু নোংরা মানসিকতার মানু্যের জন্য।

bhangar
ভাঙড়ে রাজ্যের উদ্দেশ্য ছিল, এখানে পাওয়ার গ্রিড তৈরি করা। এই হাইটেনশন লাইন মাটি থেকে অনেক উঁচু দিয়ে যাবে। এতে কোনও মানুষ বা জমির ক্ষতি হয় না। এটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত। সরকার এজন্য রাজ্যে ২০১২ সালে ১৭টি ছোট–‌বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করার ভাবনাচিন্তা করেছে। এই পাওয়ার গ্রিড করতে পারলে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, বর্ধমান ইত্যাদি প্রত্যেক জেলা উপকৃত হবে। এখনও আমাদের জেলাগুলির অনেক জায়গায় টিম টিম করে আলো জ্বলে। শিল্পের পরিকাঠামোও তৈরি করতে পারছে না রাজ্য। এই প্রকল্প হলে মানুষের বাড়িতে পর্যাপ্ত আলো পৌঁছবে। শিল্পের পরিকাটামোও তৈরি হবে।
একটি দলের প্রথম সারির নেতা বলেন, সিঙ্গুরে তো এই সরকারি দলই বাধা দিয়েছিল আমাদের শিল্প গড়তে। সেজন্য আমরাও বাধা দেব। এতে যে রাজ্যবাসী বিপদে পড়ছে, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। সেই নেতা একবারও ভাবলেন না, সিঙ্গুর আর ভাঙড় একই ইস্যু নয়। সিঙ্গুরে ছিল কারখানা তৈরির। আর এখানে পাওয়ার গ্রিড। সিঙ্গুরে যে শিল্পে সিপিএম আগ্রহী ছিল, সেই শিল্পের জমি ছিল তিন ফসলি বা চার ফসলি। আর ভাড়ড়ে পাওয়ার গ্রিড। এজন্য অতটা জমির প্রয়োজন নেই। আর এই জমির জন্য বর্তমান সরকারকে কোনও খুনখারাবি করতে হয়নি। সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও দিতে চায়। অতীতে সিপিএমের অনেক নেতা সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে ওতপ্রোতভাবে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ ছাড়াও ন্যানো গুজরাট থেকেও উঠে গেছে। এই বিরোধী দলগুলি বরং কৃষকদের উস্কানি দিচ্ছে, তোমাদের জমি আর কেউ কিনবে না, কোনও চাষ হবে না— এভাবে ভুল বুঝিয়ে উন্নয়নে বাধা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে চাষীদেরকে বোকা বানাচ্ছে।

bhangar3
বিরোধী নেতাদের বোঝা উচিত, তখনকার ‌সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রায় ১ হাজার একর জমি। আর ভাঙড়ে কৃষকদের জমির ওপর দিয়ে হাইটেনশন লাইন যাবে। যার মাধ্যমে বহু এলাকায় বিদ্যুতে ভোল্টেজ বাড়বে। ভোল্টেজ বাড়লে জেলাগুলিতে আধুনিক জগতে টিভি লাইন, রাস্তা আলোকিত হবে। এসি লাইন ইত্যাদি সহজে উপভোগ করতে পারবেন নাগরিকরা। শিল্পেও সহায়ক হবে। বিরোধীরা কৃষকদের বুঝিয়েছেন, তোমরা আর চাষ করতে পারবে না। তোমাদের জমি কেউ কিনবে না। যা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। বৈজ্ঞানিকদের ধারণা, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। পাওয়ার গ্রিড করলে সেই জমিতে চাষবাসও নিশ্চিন্তে করা সম্ভব। এই উস্কানি বিরোধী দলগুলি থেকেই আসছিল। এই উক্তিগুলি সেদিন ওই আলোচনায় প্রধানত যাঁরা সিঙ্গুরে ও নন্দীগ্রামে জমি নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তাঁদের। এই প্রসঙ্গে প্রধানত বলা যায়, সিঙ্গুর আন্দোলনের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি কোনও দিন সিঙ্গুরে শিল্প করতে বাধা দিতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, যে ঊর্বর তিন ফসলি ও চার ফসলি জমি সরকার জোর করে মেরে ও খুন করে নিচ্ছিল সরকার দ্বারা কিছু মাস্তানবাহিনী, তাতে তিনি বাধা দিয়েছিলেন। মমতা বলেছিলেন, উল্টোদিকে এক ফসলি জমি আছে। তা হলে তিন–‌চার ফসলি নেবেন কেন?‌ এই কথার যুক্তি আছে। এতে খাদ্যভাণ্ডারে টান পড়বে। এটা বাস্তব যে, সিঙ্গুরের জমি কেড়ে নেওয়ার পর বেশ কয়েক বছর বাংলাবাসীকে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। সেই জমি মমতা ব্যানার্জি পুনরুদ্ধার করে পুনরায় চাষ করে প্রমাণ করেছেন, তিনি সাধারণ মানুষের পাশেই আছেন। গুরগাঁওতে যদি ৩০০ একর জমিতে মারুতি কারখানা গড়তে পারে, তা হলে কেন সিঙ্গুরে এত জমির প্রয়োজন?‌ এর কি কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল?‌ এ ছাড়াও তখনকার সরকার কৃষকদের খুব কম ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছিল। এজন্য মারধর করে কেড়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ভাঙড়ে সেটা হয়নি। ভাঙড়ে মমতার বক্তব্য, যাঁদের জমির ওপর দিয়ে হাইটেনশন লাইন যাবে, তাঁদের দাবিমতো ক্ষতিপূরণ দেবেন। আর এই পাওয়ার গ্রিড হলে নাগরিকদের কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এটা বৈজ্ঞানিকদের মত।
মমতা ব্যানার্জি ২০১২ সালে কাটোয়ায় প্রথম এই কাজে হাত লাগান। কিন্তু কিছু মানুষকে ভুল বুঝিয়ে উস্কানি দিয়ে সেই কাজ বন্ধ করে দেন কিছু অসৎ রাজনৈতিক নেতা। যা আজও সেখানকার নাগরিকরা সেই ভুলের মাসুল গুনছেন। তাঁরা এখন বলছেন, আমরা চাই পাওয়ার গ্রিড। এর মাধ্যমেই উন্নতি হবে এলাকায়। জনগণ এখন বুঝছেন, এই অবৈজ্ঞানিক ধারণা যদি আমরা চাষীরা পোষণ করি, তা হলে তো কোথাও ট্রেন, মেট্রো চলবে না। বড় কারখানা হবে না। রাজ্যে বেকারত্ব থেকেই যাবে। রাজ্যের যুবক–‌যুবতীদের বাইরের রাজ্যে চলে যেতে হবে। এর ফলে বাইরের রাজ্যে আমাদের রাজ্যের বহু নাগরিকরা বিনা দোষে খুন পর্যন্ত হতে পারেন। যা সম্প্রতি রাজস্থান, কেরল, দিল্লি, গুজরাটে ঘটেছে।
সকলকে অনুরোধ, রাজনৈতিক নেতারা অহেতুক সিঙ্গুর আর ভাঙড়কে মেলাবেন না। আর কিছু বাইরের রাজ্যের আগত উস্কানিদাতাদের এই রাজ্যে খোঁজখবর নিয়ে প্রবেশ করতে দিন। না হলে ক্ষতি হবে শুধু আমাদের বাংলারই।ভাঙড় ভাবনা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক। মানুষকে ভুল পথে চালিত করবেন না।
‌‌‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.