মুদ্রার উল্টো দিকটাও সত্যি

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

দক্ষিণী চলচ্চিত্রাভিনেতা কমল হাসান দিন কয়েক আগে বলেছিলেন, ভারতীয় হিন্দুরাও ইদানীং অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। তারাও ধর্মান্ধতাকে লালন করছে, উগ্রতাকে আঁকড়ে ধরছে এবং প্রশ্রয়ও দিচ্ছে। স্বভাবতই এই মন্তব্যে দেশের তথাকথিত “ধার্মিক” হিন্দুসমাজ যারপরনাই ক্ষুব্ধ এবং প্রত্যাশিতভাবেই কমল হাসান তাদের চক্ষুশূল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তথা পাড়ার চায়ের দোকানে এই নিয়ে অনেকে অনেক মত দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সাবধানে এড়িয়ে যাচ্ছেন ব্যাপারটাকে, ভাবখানা এরকম, যে যা বলেছে বলেছে। কিছু মন্তব্য করব না। প্রতিক্রিয়া জানাতে গেলেই আমিও দুজন পরস্পরবিরোধীর মধ্যে যে কোনও একজনের দলে পড়ে যাব। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বস্তুতঃ কথাটা এখানে হিন্দু ধর্মকে নিয়ে নয়। বা ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যেও একটা বড় অংশ যে বিগত কয়েকবছর ধরে মুসলিমদের প্রতি বিষোদ্গার করে চলেছে বা তাদের “জাতিশত্রু” ভেবে ফেলেছে, সেখানেও কিন্তু সমস্যাটা মুসলিম ধর্মকে নিয়ে নয়। মূল কথাটা এখানে উগ্রতা বা ধর্মান্ধতা। যা সব ধর্মেই কমবেশি আছে। পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কোনও ধর্মই এখানে অহিংস বা শান্তির উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি। বরং সেই ধর্ম প্রচারের নেপথ্যে মূল উদ্দেশ্য ছিল অপর কোনও ধর্মকে জয় করা, সেই ধর্মের মানুষদের নিজেদের ধর্মে রূপান্তরিত করা। এর থেকেই বিবাদ, বিরোধ বা হিংসার সূত্রপাত। সুতরাং একধর্মের প্রতি আরেক ধর্মের বিষোদ্গারটা বাস্তবিকই ভিত্তিহীন। মুসলিমদের মধ্যে যেমন মৌলবাদ আছে তেমনি উগ্রতা হিন্দুদের মধ্যেও আছে। বা অন্যান্য ধর্মের মধ্যেও পুরোমাত্রায় আছে। ষোড়শ শতকে ইউরোপ জুড়ে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড ছিল। সেই ধর্মান্ধদের মধ্যেই সংঘাত। কখনও তা পরধর্মের প্রতি, কখনও তা একই ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। কারবালার প্রান্তরে ইসলামের “শিয়া” আর “সুন্নি” দের মধ্যে সংঘাতও তারই নামান্তর। বৌদ্ধধর্মেও হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত বা জৈনদের মধ্যে শ্বেতাম্বর ও দিগম্বরদের মধ্যেকার বিরোধ। আর হিন্দুদের মধ্যে “বর্ণাশ্রম” প্রথার কারণে তথাকথিত “উচ্চ সম্প্রদায়” ব্রাহ্মণদের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও নির্যাতনের অহরহ শিকার ব্রাহ্মণেতর গোষ্ঠীরা।

kamal hasan

সুতরাং ধর্মান্ধতাই হিংসা, সংঘাত, হানাহানির বীজ বপন করে। এখানে কোনও একটি বিশেষ ধর্ম তার ব্যতিক্রম নয়। যে বৌদ্ধধর্ম গৌতম বুদ্ধের অহিংসা ও মানবপ্রেমের বাণী বহন করে, সেই বৌদ্ধরাও ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে মায়নমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে, বহু রোহিঙ্গা নারী তাদের হাতে আক্রান্ত, ধর্ষিত। বহু অসহায় শিশু মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। বহু মানুষ এখনও গৃহহীন, অন্নবস্ত্রহীন। সেরকম ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বহু পরাক্রমশালী মুসলিম বাদশা দের হাতে অসহায় হিন্দুরা যেমন নির্যাতিত হয়েছে, কয়েক হাজার হিন্দু যেমন জীবন দিয়েছে, তেমনি পৃথিবীর অন্যত্র মুসলিমরাও খ্রীষ্টান বা অন্য ধর্মান্ধদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে বা হচ্ছে। আর বর্তমানে আমাদের দেশেও বিগত তিনবছরের বেশি সময় ধরে চলছে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার। কোথাও ঈদপালনে গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় অসহায় জুনেইদকে খুন করা হল, তো কোথাও গোমাংস রাখার মিথ্যা অপবাদে আখলাখকে পিটিয়ে হত্যা করা হল। দেশের স্থানে স্থানে চলেছে ধর্মের নামে উগ্রতা ও পরধর্মে থেকে নিজধর্মে বলপূর্বক রূপান্তর। কোথাও কোথাও ধর্মাচরণে বাধা দেওয়াও হচ্ছে। যেখানে হিন্দুরা শক্তিশালী সেখানে মসজিদ ভাঙতে প্ররোচিত করছে একদল ধর্মান্ধ, নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আবার যেখানে মুসলিমরা অপেক্ষাকৃত সঙ্ঘবদ্ধ সেখানে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ভাঙা হচ্ছে, পূজার্চনায় বাধা দেওয়া হচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুবছর আগে লিখেছিলেন, “একটা সময় আসিল যখন হিন্দু , নিজের হিন্দুত্ব নিয়ে গর্ব করতেই পারত। তা না করে তারা উগ্র হইয়া উঠিল। ফলস্বরূপ যে কারণে হিন্দুদের হিন্দুত্ব বোধ উগ্র হইয়া উঠিল, সেই একই কারণে মুসলমানের মুসলমানত্ব ও উগ্র হইয়া উঠিল।” এই কথাটি যে কতখানি বাস্তবসম্মত তা বর্তমানে সর্বধর্মের মিলনতীর্থ ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দুই দলই প্রতিশোধ স্পৃহাতে প্রজ্জলিত। তাদের কাছে যেন এই বিবাদ, এই হানাহানি কোনও বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে এই দুই সম্প্রদায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভুলে একসঙ্গে, একজোট হয়ে লড়াই করেছিল অত্যাচারী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে।

সুতরাং কমল হাসান যে মন্তব্যটি করেছেন তা সর্বৈব সত্য, কিন্তু তিনি একটি বিশেষ ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে পরধর্মকে বিচার করেছেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি যে অভিযোগ করেছেন তা যেমন সত্যি, তেমনি এর বিপরীতটাও পুরোমাত্রায় সত্যি। দুই ধর্মের উগ্রতাই পারতপক্ষে আগ্রাসনের ইন্ধন যোগাচ্ছে, সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করছে, দেশের অখণ্ডতা, সংহতির মূলে কুঠারাঘাত করছে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.