সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
টিভি চ্যানেলে দলের কিছু নেতার প্রতি বিষোদ্গার। একের পর এক “অপ্রিয় সত্য” প্রকাশ করে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করা এবং নিজেকে “বিদ্রোহী” প্রমাণ করার চেষ্টা। সর্বোপরি দলের ভাবমূর্তিকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করা। কমিউনিস্ট পার্টিতে এই ঘটনা “নজিরবিহীন” তো বটেই, এক কথায় অনভিপ্রেত এবং অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তরুণ নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় সেটাই করলেন। তাঁকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে রাজনৈতিক মনষ্করা এখন দ্বিধাবিভক্ত। কেউ তার এই কীর্তির পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। যাঁরা পক্ষে তাঁদের যুক্তি, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহস আছে দলের কিছু ক্ষমতালোভী, স্বার্থান্বেষী নেতাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, তাঁদের মুখোশ খুলে দেওয়ার। আর বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের যুক্তি, কমিউনিস্ট পার্টিতে এরকম “অন্তর্ঘাত” একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়, তা বস্তুতঃ পার্টির গঠনতন্ত্র অবমাননারই নামান্তর। আর এক্ষেত্রে “চরম শাস্তি” ই কাম্য।
ঋতব্রত কী বলেছেন তার আদ্যোপান্ত বিবরণ আমি শুনিনি। যতটুকু জেনেছি সোশ্যাল মিডিয়াতে বা বাংলা সংবাদপত্র পড়েই জেনেছি। আমি ঋতব্রতর মত কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠনের সর্বভারতীয় নেতাও নই বা সাংসদও নই। তবু সামান্য একজন বামপন্থী কর্মী বা আঞ্চলিক শাখার সদস্য হিসেবে বলতে পারি, কমিউনিস্ট পার্টির মতো রেজিমেন্টেড একটা দলে বিভিন্ন কর্মী বা সদস্যদের মতানৈক্য থাকলেও সর্বসম্মতিক্রমে দল যা সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই প্রতিটি কর্মী-সদস্যদের মেনে চলা উচিত। মতের অমিল হতেই পারে, কিন্তু তার জন্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করাটা একেবারেই অশোভন। দলীয় শৃঙ্খলা বা নিয়মনীতির প্রশ্নে কোনও পার্টিকর্মীরই দলের ঊর্ধ্বে যাওয়া একেবারেই কাম্য নয়। এই পার্টিতে সবাই একটা নীতির অনুসারী, একটি সুনির্দিষ্ট পথের পথিক। সেই পথের যাত্রীদের তাই নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা থাকা খুব জরুরি। এখানে কেউই নীতির ওপরে নয়। প্রত্যেকেই সেই নীতিতে বাঁধা।
ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও ব্যক্তির প্রতি অসন্তোষ থাকতেই পারে। প্রতিটি মানুষ তো আর মানসিকতার বিচারে সমান বা সমতুল্য হতে পারেন না। কিন্তু সেই অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশটা দলীয় বৃত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিল। কেন তা সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রকাশিত হবে ? ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বর্তমান প্রজন্মের একজন দায়বদ্ধ, প্রতিশ্রুতিমান বামপন্থী নেতার থেকে এই আচরণ একেবারেই মানানসই নয়, যিনি আবার রাজ্যসভাতে দলের সাংসদও। তিনি যে যে অভিযোগের ভিত্তিতে বিষোদ্গার করলেন একটি টিভি চ্যানেলের সামনে, তার সত্যাসত্য নিয়েও সংশয় থেকেই যায়। তবু সেই অভিযোগগুলো তার দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছেই জানানো উচিত ছিল। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলে তিনি প্রমাণ করলেন তিনি দলের এক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হয়েও দলের গঠনততন্ত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন। আর যদি তিনি স্বেচ্ছায় দল থেকে নিজের বহিষ্কারের পথ সুগম করতে এই “অন্তর্ঘাত” এর আশ্রয় নেন, সেটা অবশ্য আলাদা কথা। সেক্ষেত্রে এটুকুই বলতে পারি, দলের উচিত সদস্যপদ দেওয়া ও দলের মধ্যে সদস্যদের পদোন্নতির ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সচেতন হওয়া ।
বর্তমানে বাংলায় তথা সারা দেশে বামশক্তি যখন ক্ষয়িষ্ণু, যখন সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে, যখন স্বৈরাচারী, দক্ষিণপন্থী শক্তির গ্রাসে গোটা দেশ, তখন বামপন্থীদের অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হওয়াই সমীচীন। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ ভুলে একসঙ্গে দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করাই আশু কর্তব্য। সেখানে ঋতব্রত বন্দ্য়োপাধ্যায়ের এ হেন আচরণ বস্তুতঃ নিজের তথা দলের আত্মহননেরই পরিচায়ক এবং পারতপক্ষে তা বিরোধী দক্ষিণপন্থী শক্তিকেই আরও শক্তিশালী করবে।