(টিভি চ্যানেলে এক ঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকার। আপাতত সেটা নিয়েই ঝড় রাজ্য রাজনীতিতে। অনেকে ঋতব্রতর পক্ষে, অনেকেই বিপক্ষে। সেই সাক্ষাৎকার দেখা তাঁকে খোলা চিঠি। লিখলেন অভিরূপ কুমার।)
রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, সাম্প্রতিককালে কমিউনিস্ট পার্টির তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে আপনি অগ্রগণ্য। আপনার জনপ্রিয়তার প্রশ্নে আমাদের কোনও দ্বিমত নেই। আপনিও আত্মবিশ্বাসী। বামপন্থী রাজনীতিতে আপনি এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। আপনার সাক্ষাৎকারের প্রধান কারণ হল সিপিএমের লক্ষ লক্ষ সমর্থক, যাঁরা আজও পার্টির পতাকা নিয়ে লড়াই করছেন। আপনি নাকি তাঁদের কাছে জবাব দিতে চেয়েছেন। আপনি কোনদিন জবাব দিলেন? যেদিন সারা রাজ্য জুড়ে ওই লোকগুলোর রক্ত ঝরল। আপনার মনে হতে পারে, তাঁরা আপনার সঙ্গে আছেন। কিন্তু সত্যটা হল, তাঁরা লাল পতাকার সঙ্গে আছেন।
আমার ৬২ বছরের অসুস্থ মাও আশ্বিনের তীব্র দাবদাহকে মাথায় নিয়েই মেদিনীপুরের রক্তাক্ত মাটির ওপর পাঁচ কিলোমিটার হেঁটেছেন। তিনি অসুস্থ হয়েছেন, সন্ধের পর সামান্য সুস্থতা ফিরে পেলে আপনার সাক্ষাৎকার দেখা শুরু করেছিলেন। বিশ্বাস করুন, আপনার সাক্ষাৎকার শোনার পর আপনার বিরুদ্ধে কোনও রাগ পোষণ করেননি। রাগ পোষণ করেছিলেন সেইসব নেতাদের প্রতি, যাঁদের জন্য আপনি রাজ্য কমিটি ও রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, এরকমই একটি সাক্ষাৎকার শুনেছিলাম। একই চ্যানেলে, একই সময়ে, সেদিনও সঞ্চালক ছিলেন সুমনবাবু। তবে, সেদিন হটসিটে ছিলেন মানস ভুঁইয়া। দুজনেরই অভিযোগ দলের কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে, দলের বিরুদ্ধে নয়। মানুষ ভুঁইয়ার পরিণতি আজ কারও অজানা নয়। তাঁর নৌকা সেই বন্দরেই ভিড়ল, যেখানে তিনি যেতে চেয়েছিলেন। অবশেষে, রাজ্যসভায় আজ তিনি আপনার সতীর্থ। কী জানি, আপনার নৌকো শেষমেষ কোন বন্দরে গিয়ে ভিড়বে।
দলের প্রতি অনুগত আপনি কোনওদিনই ছিলেন না। কঠিন ভাষায় আনুগত্যকে কমিউনিস্ট পার্টিতে বলা হয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। তাতে যে আপনার ন্যূনতম বিশ্বাস নেই, একঘণ্টার সাক্ষাৎকারে ছত্রে ছত্রে বুঝিয়ে দিয়েছেন। রাজ্যের বামপন্থী সমর্থকরা এই কঠিন সত্যটি বুঝতে না পারলেও পার্টির প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ তাঁরা দিয়েছেন, ভবিষ্যতেও দেবেন। তাঁরা আপনার মতো সেলিব্রিটি নন, কিন্তু তাঁদের লড়াই ও মূল্যবোধ আপনার থেকে অনেক বেশি। তাঁদের থেকে যদি একটু মূল্যবোধ শিখে নিতে পারতেন!
আপনার অপরাধ (আপনার ভাষাতেই বলি) সংসদে আপনি সোচ্চার ছিলেন। যেন বাকি সাংসদরা বোবা–কালা হয়েই সংসদে যেতেন। সোমনাথ লাহিড়ি, হীরেণ মুখার্জি, জ্যোতির্ময় বসু, সোমনাথ চ্যাটার্জি, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সঈফুদ্দিন চৌধুরিদের বাগ্মীতা ও লড়াই কোন উচ্চতায় পৌঁছেছিল, একটু সময় পেলে পড়ে নেবেন।
আপনি হয়ত জানেন না, সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে হাজার হাজার এম এল এ, এম পি বা অন্যান্য জন প্রতিনিধিরা জনগণের সংস্পর্শে থেকেই কাজ করেছেন। মিডিয়ার সার্চলাইট থেকে অনেক দূরে, সোসাল মিডিয়া থেকে অনেক দূরে, তাঁরা নিশব্দে কাজ করে গেছেন। নিজের ঢাক নিজেদের পেটাতে হয়নি। আজও ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্যে বামপন্থী দলগুলির বিধায়ক এবং সংসদের দুই কক্ষে একাধিক সাংসদ রয়েছেন। তাঁদের কথাও গণশক্তিতে খুব বেশি লেখা হয় না। তাঁরা এসব নিয়ে ভাবেন বলেও মনে হয় না। কিন্তু আপনার রাগ, গণশক্তি কেন আপনার প্রতিটি বক্তব্য তুলে ধরেনি। আপনি জানেন, গণশক্তি আজ কারা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন? আপনি কি জানেন, কত আক্রমণ সহ্য করতে হচ্ছে সেই সব হোলটাইমারদের, যাঁরা গ্রামে গ্রামে এখনও গণশক্তিকে পৌঁছে দিচ্ছেন। আপনার পার্টির সেইসব সর্বক্ষণের কর্মীর কথাও গণশক্তি খুব একটা লেখে না। তাঁদের জন্য আপনার কোনও কষ্ট হয় না। গতকালের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন, আপনি জানেন? সেই আক্রমণকেও সহ্য করা যায়। টিভিতে বসে পার্টিকে যে আক্রমণ করলেন, তা অনেক বেশি বেদনাদায়ক।
২০০৪ সালে বামপন্থী দলগুলি ইউপিএ ওয়ান সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ বামপন্থী কর্মী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ২০০৪ সালের বিজেপি অপেক্ষা ২০১৯ এর বিজেপি কয়েকশো গুণ বেশি ভয়ঙ্কর। স্বাভাবিকভাবেই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কোয়ালিশনের প্রয়োজন আছে। প্রকাশ কারাত এই মতের বিরুদ্ধে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররাও প্রকাশ কারাতের মতের বিরুদ্ধে। আপনি ভুলে যাবেন না, আপনি এখনও সিপিএম জেলা সম্পাদকমণ্ডলির সদস্য এবং সিপিএমের নির্বাচিত রাজ্যসভার সদস্য। আপনি কী করলেন? প্রকাশ কারাতের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে গিয়ে নগ্নভাবে ব্যক্তি আক্রমণের রাস্তায় হাঁটলেন। আপনি সাক্ষাৎকারে বারবার জ্যোতি বসু, সুভাষ চক্রবর্তী, গৌতম দেব, সুজন চক্রবর্তীর নাম নিলেন। এই নামগুলো নেওয়া কি খুবই প্রয়োজন ছিল? আপনি কী প্রমাণ করতে চাইলেন? এই ব্যক্তিদের প্রতি কমিশনের কোনও শ্রদ্ধা নেই। মানুষের মধ্যে যখন যুক্তির অভাব থাকে, তখনই মানুষ এ কাজ করে। আপনি সিপিএমের সেন্ট্রাল কমিটিকে বাঙালি বিরোধী বানিয়ে দিলেন। যে লক্ষ কোটি সমর্থকের জন্য আপনি টিভিতে এলেন, তাদেরকে যখন মানুষ প্রশ্ন করবে, তারা কী উত্তর দেবে? কখনও কখনও মনে হয়, আপনাদের মতো তরুণ নেতাদের দ্রুত পার্টিতে উঠিয়ে আনাই বোধ হয় কাল হয়েছে। ব্রতীন সেনগুপ্ত থেকে আপনি, তারই বোধ হয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
আপনি বলেছেন, আপনি গাড়ি চড়েন আপনার মিটিংয়ের পয়সায়। কমিউনিস্ট পার্টিতে সেটাই রেওয়াজ। অন্য সমস্ত এমএলএ, এমপি–রাও তাই করেন। খুঁজলে এমন বহু এমএলএ, এমপি পাওয়া যাবে যাঁরা স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংয়ের টাকাও পার্টিকে দিতেন। আপনার মুখেই শুনলাম, এবং অত্যন্ত আশ্চর্য হলাম, কমিশনের সমস্ত কথোপকথন আপনি টেপরেকর্ড করে রেখেছেন। এরপর তো মানুষ আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাবে। ফোন করতে, এমনকী আপনার ফোন ধরতেও ভয় পাবে। কী জানি, আপনি হয়ত রেকর্ডিং করছেন। নিজের সহযোদ্ধাদের কাছেও কতখানি বিশ্বাস হারালেন, ভেবে দেখেছেন?
ন্যূনতম নীতিবোধ থাকলে এভাবে রেকর্ড করা যায় না। ন্যূনতম লজ্জা থাকলে তা প্রকাশ্যে বলা যায় না। নীতিবোধ ও লজ্জা, এই দুটোই আপনি হারিয়েছেন। মানসবাবু অন্তত রেকর্ডিং ফাঁসের হুমকি দেননি। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে এটাই প্রমাণ হয়, আপনার সঙ্গে কারও তুলনা করা চলে না। শুরুতে মানসবাবুর সঙ্গে তুলনা করে অন্যায় করেছি। ভূভারতে আপনার তুলনা আপনি নিজেই।
আপনার সাক্ষাৎকার দেখে বারবার মনে হচ্ছিল, আপনি পার্টিকে প্ররোচিত করছেন আপনাকে বহিষ্কার করার জন্য। সত্য না হলেই খুশি হব, তবু বারবার মনে হচ্ছিল, আপনার শরীরটা এখনও এখনও সিপিএমে থাকলেও মনটা বলছে, ‘রঙ দে তু মোহে গেরুয়া’।
আমরা জানতাম না আপনার এরকম একটি কঠিন রোগ আছে বলে। আপনি অসুস্থ, এটাও আমরা জানলাম সাক্ষাৎকার থেকে। আপনি দ্রুত সুস্থ হোন, এই কামনাও করি। আপনি আপনার ব্যক্তিত্বের ওজন হারিয়েছেন। ভাল হয় যদি দ্রুত শরীরের ওজন কমান। এজন্য আপনার প্রতি পরামর্শ রইল, আলু, চিনি, মিষ্টি, ভাজা, চকলেট, আইসক্রিম, ডিমের কুসুম, এবং অবশ্যই রেড মিট কম করুন। আরেকটি রোগ পেলাম। যেটা হল, আপনার মতাদর্শের দৈন্যতা অথবা পদের প্রতি লোভ। এই রোগটির চিকিৎসায় কোনও পরামর্শের প্রয়োজন নেই। ইতিমধ্যেই আপনার পার্টি তার চিকিৎসা করে দিয়েছে। আপনার পার্টিকে অভিনন্দন তাঁরা তাঁদের কঠিন দুর্দিনেও আপনার চিকিৎসা করার দায়িত্ব থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখেননি। বরং পরামর্শ রইল তাঁদের প্রতি, যাঁদের মধ্যে আপনার রোগটি বিকশিত হচ্ছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁরাও যদি সতর্ক না হয়, আগামীদিনে পার্টি তাঁদেরও চিকিৎসা করবে। বিশ্বাস করুন, এই চিকিৎসাটিই পার্টি করেনি লক্ষ্ণণ শেঠ, রেজ্জাক মোল্লাদের বেলায়। সুদিনে তাঁদের চিকিৎসা করতে পারলে আজকে এই দুর্দিন দেখতে হত না।