অম্লান রায়চৌধুরী
আবার এক স্বাধীনতা উৎসব এসে গেল।
‘স্বাধীনতা’ ‘স্বাধীনতা’ খেলা। তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে, বন্দেমাতরম্ হুঙ্কার ছেড়ে, চেনা জানা কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম আউড়ে–তাঁদের নিয়ে জানা অজানা কিছু বক্তব্য দিয়ে মঞ্চ মাতানো কিছু বিদ্বজনের সাদা পোষাকে আনাগোনা–জয় হিন্দ ধ্বনি দেওয়া –এরই নাম আজ কাল স্বাধীনতা খেলা ।
রাজনৈতিক মিছিলে অবশ্য ‘বন্দেমাতরম্’টা রোজই শোনা যায়। ‘জবাব দাও, ক্ষতিপূরণ দাও, ভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ কিংবা ‘এভাবে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না’ -প্রত্যেকটা স্লোগানের পরেই ‘বন্দেমাতরম্’। এক সার্থক মাতৃবন্দনা। …যাই হোক, আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবরে কাজ নেই ভেবে যখন দেখি, শঙ্খ ঘোষ, শুভ দাশগু বা অমর্ত্য সেনরা আছেন ফাঁপা ঢাক পেটানোর গালমন্দ করতে–বেশ নিজেদের বোদ্ধা মনে হয়। আমরা ছা-পোষা মানুষ। স্লোগানও শুনি, জ্যামে আটকেও থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাম নিয়ে বাসে। আবার নন্দনেও যাই, কবি সভাতেও থাকি, দুচারটে কবিতাও লিখি , শুনিও । স্লোগানকারীদেরও বাহবা দিই আবার কবিদেরও কাছে থাকার চেষ্টা করি ।
তবে যাই বলিনা কেন, আমার মনে হয় আমরা সারা বছর ধরেই স্বাধীনতা-সচেতন থাকি। অন্তত পতাকা সচেতন। ‘জনগণ মন’ সচেতন, জনগণের মন সচেতনতা ভুলে। থাকি, কালচার সচেতন, যেটাকে আঁকড়ে রাখার অদম্য ইচ্ছাকে রুপায়িত করতে – কী করব ওটাই তো ভুলে থাকার একমাত্র উপায় , যেটা ভোলানোর চেষ্টা সারা দেশ ভরে — আদি থেকে আধুনিক সব সাহিত্য কর্মকেই যে বাতিল করার ঝোঁক এসেছে – অতি জাতীয়তাবাদীদের। বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু ভয় যে আছে সেটাও বুঝতে পারি যখন শুনি রহমানের উচ্চারনে ‘চিত্ত যেথা ভয়শুন্য’তে পাশ্চাত্য টান — দেখে আমাদের চিত্ত জ্বলে ওঠে। শাহরুখের মুখে ‘টেগোর সাব’ শুনে তখনই তাকে ‘গোর’ দিতে ইচ্ছে করে। এরকম আরও কত…..

পতাকা নিয়ে আমাদের গাদাগুচ্ছের আইন আছে। ফ্ল্যাগ কোডের আতিশয্যে আমরা বেশ আনন্দিত। বেশিরভাগ দেশেই ‘পতাকার অবমাননা’ বলতে শুধু পোড়ানো, থুতু ফেলা, মাটিতে ঘষটানো, পদদলিত করা, পাথর ছোঁড়া, কাঁচি চালানো ইত্যাদি কয়েকটা চরম নোংরামিকে বোঝায়। আমরা সেখানে ব্যান করার অছিলায় গোটা একটা মহাকাব্যর পিত্তিকে টেনে এনে আয়ুর্বেদিক রস ঢুকিয়েছি নানান পাত্রে। শুধু তাই নয়, খোঁয়ার পালানো শুয়োরের মত অপরাধীদের সন্ধানে দিনে ছাব্বিশ ঘণ্টা নানান ব্যবস্থা ঝুলিয়ে রেখেছি – হ্যাঁ কিছু মানুষের দু পয়সা আসছে তাতে, ওটাও একপ্রকারের দেশ ভক্তির নমুনা। খালি ভাবি এই বুঝি কেউ ফসকে গেল। …..সে নয় ফসকালো, কিন্তু আমার দেশভক্ত গোয়েন্দাগিরির পরাকাষ্ঠাটাকেও যে ফসকে দিল, প্রকাশ্যে এল। এ যন্ত্রণা বোঝার মত কলজে কারোর আছে? কী বলেন সিধু, কানহু, মাষ্টারদারা ?
দেশটা ওয়ার্ল্ড কাপ জিতেই মুশকিল করল। হরভজন আনন্দের চোটে অঙ্গে জড়িয়ে ফেলল জাতীয় পতাকা। জাতীয় পতাকা…. ভাবা যায়? নেহাৎ রবি ঠাকুরের লেখা বলে, নইলে ‘পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা’-র ‘পাঞ্জাব’টাকে শো-কজ করা হত। হরভজনের পরে ওই শাহরুখ খান আবার এক কাণ্ড করে বসলেন। দেশের বিশ্বজয়ের আনন্দেই। পতাকাটাকে মাথার উপর বনবনাও, কেউ বারণ করে নি। কিন্তু ঘূর্ণির চোটে উলটে নিয়ে পালটে দিলে? গেরুয়া নিচে আর সবুজ উপরে? কী দুঃসাহস! লে ঠোক এফ.আই.আর. বাদশার নামে, কে কোথায় আছিস?
এ তো গেল সেলেব্রিটি। আরো কত ছোটখাটো ঘটনা লেগেই আছে। জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাহান্ন সেকেণ্ডের জায়গায় সাতান্ন সেকেণ্ড লাগল কেন? মেঘের আড়ালে সূর্য পাটে চলে গেছে, তাও পতাকা নামানো হয়নি কেন ? এফ আই-আর- করা হবে। আর পতাকা আঁকা? ওতে তো খুব কশাস্ থাকতে হবে। কতটা সাদা থাকলে অশোক চক্র কতটা বড় হবে, একচুল যেন এদিক ওদিক না হয়।
আরে পতাকা নিয়ে এত টানা হেঁচড়া , পতাকার পেছন দিকটা কেমন , পতাকা টা এল কীভাবে – সেই যে বণিকদের রাজদন্ড হস্তান্তরিতের কাহিনীগুলো , মাঝরাতে টেবিলের এপার ওপার এক করে – সেগুলো কি একটু বুঝতে চাই আমরা – নাকি বোঝানোর চেষ্টা আছে । যে বলিদানগুলো হয়েছে , শুধু ঠান্ডা ঘরের কাগজ হস্তান্তরিত স্বাধীনতার দৌলতে – সেগুলো কে বলবে – আজকে স্বাধীনতার প্রাক্কালে ।
আমাদের অবাক লাগে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, বেলজিয়ামের কথা ভাবলে। কোনো ‘ফ্ল্যাগ কোড’ই নেই? যে যা খুশি করতে পারে পতাকা নিয়ে? আর ডেনমার্ক? নিজের দেশের পতাকার উপর ক্ষোভ দেখালে কোনো দোষ নেই, কিন্তু দেশের মাটিতে অন্য দেশের পতাকা নিয়ে কিছু করেছ তো হাজতবাস! বিশ্বশান্তি রক্ষার এ এক নবতম ঢং । মেক্সিকোর ব্যাপার স্যাপারও অদ্ভুত। নাম-কা-ওয়াস্তে বলা আছে পতাকা অবমাননা করলে অনেকদিনের জেল হবে। কিন্তু হয় আদতে সামান্য জরিমানা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যাণ্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পেরুতে কি আইন আছে জানি না। তবে লোকজন পতাকা দিয়ে আখছার এটা ওটা করছে, তাই দেখে কেউ কিস্যু বলছে না। কানাডা, হাঙ্গেরী, ভেনিজুয়েলাতে আবার পতাকার উপর অত্যাচার করে জনগণ জাতীয় প্রতিবাদ জানায়। আশ্চর্য!!
জার্মানি, আয়ারল্যাণ্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, আর্জেণ্টিনা, সুইজারল্যাণ্ড, ফ্রান্সে ‘ফ্ল্যাগ ইস্যু’ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, শাস্তিও হয় কেউ মানহানি করলে। তবে একদম শুরুতে যেগুলোকে ‘চরম নোংরামি’ বলে এলাম, তেমন অসভ্যতা করলে। আমাদের ওটুকুতে মন ভরবে না। এ ব্যাপারে ওরা আমাদের চেয়ে পিছিয়েই আছে। আমাদের আদর্শ হল তুরস্ক, পাকিস্তান, চীন। ওরা যেমন কড়া, আমাদের সেরকমই থাকতে হবে। তবেই না দেশমাতার ‘শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’।
আজ আবার তেমন একটা দিন এসেছে। নিজেদের জাহির করার দিন। নাকে-কাঁদা সিরিয়ালগুলোও আজকের দিনে স্পেশাল এপিসোড দেখাচ্ছে। সেই এপিসোডে কুচুটে শাশুড়ি থেকে সর্বহারা বৌ সবাই পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে কেমন স্বাধীনতা-স্বাধীনতা খেলছে। যেমন খেলা দেখছি টিভিতে বিপ্লবীদের লিষ্টের রদবদল, নতুন বিপ্লবী দের নাম উঠে আসা, কিছু বিদ্দ্বজনের গম্ভীর মুখে দেশাত্মবোধক গান নিয়ে আলোচনা । আমরাও খেলব।

আমাদের দেখাদেখি আরো কত লোক খেলবে।
কিন্তু সবাই কি আর স্বাধীনতার মর্ম বোঝে? ওই যে রাস্তা দিয়ে সব্জির ঝুড়ি টানতে টানতে যে লোকটা যাচ্ছে, ওই যে রিকশাওয়ালাটা ক্লান্ত হয়ে ঝিমোচ্ছে, সারাদিন ঘুরে যে লোকটা একটাও কাজ না পেয়ে বিনা পয়সায় বাড়ি ফিরছে , যে লোকটা অসুস্থ মা কে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছে – ভর্তি নিচ্ছে না, যে লোকটা কারখানার গেটের সামনে গিয়ে জানতে পারল কারখানা উঠে গেছে, এদের দেখলে কেবল করুণাই হয় । জমাট বাঁধার রসদটুকুও ওরা হারিয়ে ফেলেছে – যেমন সদ্য পাশ করা ছেলেটিকে একা অসুস্থ মাকে ফেলেই পাড়ি দিতে হচ্ছে অন্য দেশে চাকরির জন্য – উপায়হীন ভাবে । এরা সত্যিই স্বাধীন দেশের হাওয়া বাতাস খেয়েও স্বাধীন থাকার তাৎপর্য্যটাই বুঝল না। বুঝবেই বা কী করে? সবাই কি আর আমাদের মতো? আমরা হলাম জাতীয় পতাকার যোগ্য ধারক। গেরুয়া মানে সাহস আর ত্যাগ। আমরা এই যে কত সাহসের সাথে কত দেশদ্রোহীদের কাঠগোড়ায় তুলছি, কূটকচালী করে সময় সদ্ব্যবহারের সুযোগকে ‘ত্যাগ’ করছি – সে তো সবাই দেখছে। এমনও হয়ত দেখব কোনও মঠের গেরুয়া পরা তথাকথিত কোনও ত্যাগী পুরুষ – দেশ নেতা হয়েছে – ত্যাগের দ্বারা। দেখছি কেমন ত্যাগের দ্বারা জনতার উপর নজর দারির নজীর জীবনের প্রতিটা ছত্রে — এমন কি জীবন শেষে শশ্মান ঘাটেও ডিজিটের পাবন্ধী – সন্দেহের বশে, ত্যাগকে সাক্ষী রেখে । সাদা রঙের মর্যাদা রক্ষায় আমাদের নেতারা কী নিষ্ঠাবান সত্যবাদী এবং শান্তিকামী সেটা তো দেখছি। সমস্ত কেলেঙ্কারিগুলোর জন্য যদি একটি করে ফুটকি ব্যবহার করি – দেখা যাবে এতদিনে — পতাকার সাদা রঙ্গটাকেই আর চেনা যাচ্ছে না, আর আমরাও প্রতিদানে তাঁদের প্রতি বিশ্বাস রেখে জায়গামতো ‘শিভ্যালরি’ দেখাই, যেমনটা পতাকার সবুজ রঙ আমাদের হতে শিখিয়েছে। আর অশোক চক্রের অর্থ মেনে আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এই তো একটা সত্যিকারের ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্র।
একটা আবৃত্তি কানে আসছে। কোথায় মাইকে বাজছে যেন! বুঝলাম দেবেশ ঠাকুরের লেখা ‘ভারতবর্ষ’ কবিতাটি । কিছু লাইনে মনোনিবেশ করতেই হলো আজকেওঃ-
“ভারতবর্ষ মানে শুধু
মীনাক্ষীপুরম কিংবা জামা মসজিদ নয়
ভারতবর্ষ মানে নেহেরুজির বংশানুবৃত্তি
কিংবা জিন্নাসাহেবের অলিখিত শ্বেতপত্র নয়
ভারতবর্ষ মানে এক ভালবাসা
আমার তোমার শব্দের সঙ্গীতের জীবনের আকাশের মাটির”
…………………………………………
…………………………………………
“আমার ভারতবর্ষে আমি শুনেছি
মহম্মদ রফির সঙ্গে লতার ডুয়েট
দেখেছি পাল্লা দিয়ে আজহারের সঙ্গে সচিনের দৌড়
খেলার মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে শুনেছি
নঈমউদ্দিনের তদারকি চিৎকার-
‘বিজয়ন- আকিল- কুলজিৎ – বাইচুং-
মাঠটাকে আরও বড়ো কর –
মাঠ দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে
মাঠটাকে আরও বড়ো করা দরকার
অনেক অনেক বড়ো…”
এসব আঁতেল কবিতার মানে আমরা বুঝি না। সহজ কথা সহজভাবে বলতে পারে না। এত জটিল করে বলার মানে কী? আবার ধর্ম, রাজনীতি –সব ঘেঁটে একাকার করে দিয়েছে দেখছি। কবি নয় তো, যেন দেশত্রাতা ।
এই কথাটা আমরা কেন বলি না যে আমার স্বাধীন ভারতবর্ষে কোনও গেরুয়া রাজনীতিবিদ কিংবা ইমামের নির্দেশিকা নেই। এখানে কোনও সংহিতা বা কোরান ছাড়াই কোজাগরী চাঁদের অকৃপণ আলো পড়ে চিরকালীন সবুজ মাটিতে আর রমজানী চাঁদ তুলসীর মঞ্চের গায়ে পূর্ণ আলো দিয়ে যায় তখনই আজান আর লক্ষ্মীর পাঁচালীর সমবেত সঙ্গীত কানে আসে ।
