কুণাল দাশগুপ্ত
সেই কুস্তি আজও চলেছে । সাতের দশকের মাঝমাঝি সময় থেকে কেন্দ্রে বহু ধরনের সরকার এসেছে । জনতা, কংগ্রেস ,বি জে পি , হরেক কিসিমের । রাজনীতি , অর্থনীতি , শিল্পনীতি মধ্যে প্রভেদ থাকলেও কিশোর কুমারের সঙ্গে ম্যারাথন যুদ্ধে কোনও পার্থক্য নেই । কিশোরে কুমারেরও কোনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই । ৭৮ আর পি এম রেকর্ড থেকে শুরু করে হাল আমলের ডিভিডি, তৃতীয় গাঙ্গুলির গান মানুষের মস্তিস্কের কোষ থেকে কোষান্তরে ঘুরপাক খেয়েছে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে । গান বিক্রেতার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বেড়েছে তাঁর গান বেচে। কপি সিঙ্গাররা সিঙ্গার হয়েছেন তাঁর গানে ঠোঁট মিলিয়ে । কিন্তু চলন্ত ট্র্যাডিশনে ব্রেক চাপা হয়নি। উপেক্ষার আরেক নাম যেন কিশোর কুমার।
চারের দশকের শেষার্ধে পথ চলা শুরু। শুরুতেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। মুম্বইয়ের স্পিনার পদ্মাকর সিভালকারের দশা হতে পারত কিশোর কুমারের। সিভালকার প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় দলে সুযোগ পাননি বেদি, চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন , বেঙ্কট রাঘবনরা থাকায়। কিশোর কুমার যখন প্লে ব্যাক শুরু করলেন, তখন মুম্বইয়ের ময়দানে রয়েছেন তালাত মামুদ, মহম্মদ রফি, মান্না দে, হেমন্ত কুমার, মুকেশরা। এদের মধ্যে রফি, তালাত মামুদদের মারকাটারি বাজার। নৌশাদ, রোশন , শঙ্কর- জয়কিশেন ওপি নাইয়ারের মতো সঙ্গীত পরিচালকরা রফি, মান্নাতেই আসক্ত ছিলেন। শচীন দেববর্মণ অক্সিজেনটুকু না জোগালে প্রতিভার ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হয়ে যেত সেই সময়েই ।
কিছু নিজের ছবি আর কিছু দেবানন্দের , এই নিয়েই পাঁচের দশকের কিশোর কুমার । আর তারই মধ্যে পেইং গেস্ট , ফান্টুস জাতীয় ছবিতে গান হিট হয়েছে । কিন্তু দিলীপ কুমার, রাজ কাপুরের মতো নায়করা তো রফি, মুকেশ বা তালাতেই আটকে ছিলেন। গোটা পাঁচের দশকে হাতে গোনা কিছু গান গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। ছয়ের দশকেও খুব একটা ভাল যায়নি কিশোর কিশোর কুমারের। শঙ্কর- জয়কিষেন,, শাম্মি কাপুরের জুটি মার্সিডিজ বেঞ্চের মতো দৌড়েছে। সঙ্গে মহম্মদ রফি। রাজ কাপুর মজেছিলেন মুকেশে। মাঝে মান্না দে। দিলীপ কুমার তালাত থেকে সরে গিয়ে রফিতে ডুব দিলেন। সবেধন নীলমণি সেই দেবানন্দ । তাঁর গানে আবার ভাগ বসাতেন রফি , হেমন্ত কুমার। তাই এই সময়টাতেও ভরসা শচীনকর্তা । এমনকি রাহুল দেববর্মণ ও তাঁর প্রথম ছবি ছোটে নবাব- এ কিশোরকে নিতে সাহস করেননি। ‘শ্রীমানজি’ সুপার ডুপার হিট। কিন্তু সেখানেও তো কিশোর কুমার নেই। কিশোর কুমারকে ৬৯ সাল পর্যন্ত রাহুল দ্রাবিড় হয়ে থাকতে হয়েছে। বাঁ পা বাড়িয়ে রক্ষণাত্মক খেলা । অন্য দিকে গোকুলে বেড়ে চলেছিলেন রাজেশ খান্না । শক্তি সামন্তের আরাধনা মুক্তির পর কিশোর- রাজেশ জুটি মনে করাল পেলে – গ্যারিঞ্চাকে । সেলুলয়েডের বাইরের পরশ পাথর। সফর, সচ্চা ঝুটা , অমর প্রেম, কটি পতঙ্গ বক্স অফিসে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সঙ্গীত পরিচালকরাও লাইন লাগানো শুরু করলেন মুম্বইয়ের গৌরীকুঞ্জের সামনে । কে নেই সেই লাইনে? শঙ্কর- জয়কিষেণ, মদন মোহন, ওপি নাইয়ার, লক্ষ্মীকান্ত – প্যারেলাল, কল্যাণজি- আনন্দজি , আর পিতা পুত্র দুই বর্মণ তো ছিলেনই ।
নায়কদের মধ্যে যারা মহম্মদ রফিকেই পছন্দ করতেন, তাঁরাও তখন কিশোর কণ্ঠের জন্য আকূল । এই দলে ছিলেন দিলীপ কুমার , শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, জিতেন্দ্রর মতো তাবড় অভিনেতারা। সাতের দশকের মাঝামাঝি । ভারত জুড়ে কিশোর ঝড় ।অন্য দিকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা । চলছে জরুরি অবস্থা । ইন্দিরা তনয় সঞ্জয় গান্ধীর বিনা পয়সায় গান গাওয়ার হুকুম উড়িয়ে দিলেন কিশোর কুমার। রেডিওতে নিষিদ্ধ হল কিশোর কুমারের গান । ইথার তরঙ্গের দরজা বন্ধ কিশোর কণ্ঠের জন্য। এই নিষেধাজ্ঞা অবশ্য খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সাতাত্তর সালে মোরারজি দেশাইয়ের সরকার আসার পর রেডিওতে আবার বাজতে থাকে কিশোর কুমারের গান ।
কিন্তু প্রকৃত সম্মান পেলেন কোথায় ? হিট গানের সংখ্যা তো কারও থেকে কম নয়। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী বলেছেন, কুছ তো লোগ কহেঙ্গের মতো গান সবাই গাইতে পারেন না। তবু কোনও গান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেল না। অথচ, ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার তিনি বহুবার পেয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোনও পুরস্কার বা স্বীকৃতি জোটেনি এই শিল্পীর। তাঁর সমসাময়িক প্রায় সবার নামের আগে ‘পদ্মশ্রী’ বসেছে । পরবর্তী প্রজন্মে তো ঝুড়ি ঝুড়ি পদ্মশ্রী। তিনি কিন্তু বঞ্চিতই । এমন অনেক গান আছে , যেগুলো কিশোর কুমারের সঙ্গে তাঁরাও গেয়েছেন। কিন্তু মানুষ গ্রহণ করেছে কিশোরের গানকেই । যেমন তুম বিন যাঁউ কাঁহা । রফিও গেয়েছেন । কিন্তু হিট কিশোরের গলাতেই । সমঝোতা গমো সে কর লো লতা মঙ্গেশকার ও গেয়েছেন। মানুষ নিয়েছেন কিশোর কুমারকেই । জিন্দেগি এক সফর আলাদা করে গাইলেও হিট কিশোরেরটাই ।
সবকিছুর পরেও বঞ্চনাই অমরত্ব লাভ করেছে। মৃত্যুর ৩০ বছর পরেও কিশোর কুমারকে মরণোত্তর সম্মান জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কেন্দ্রের সরকার । এই জায়গায় কংগ্রেস বা বিজেপি-র মধ্যে তেমন কোনও ফারাক চোখে পড়ে না। এখন বেঁচে থাকলেই বা কী হত! বড়জোর একগুচ্ছ সরকারি তাঁবেদারের সঙ্গে বঙ্গভূষণ জুটত। কিশোর কুমার তাঁবেদারি করেননি কোনও সরকারের । সঞ্জয় গান্ধীর লাল চোখ উপেক্ষা করেছেন। ফলে সঞ্জয় পন্থীদের তো বটেই, তাঁর উল্টোদিকের শিবিরের কাছেও অপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন। এটা হচ্ছে এই মহান দেশের জটিলতম অঙ্ক। বাম , অতি বাম, ডান, অতি ডান একসঙ্গে সকলের চক্ষু শূল হয়েছিলেন বোধ হয় কিশোর কুমার। তারই ফল এই অন্তহীন অবজ্ঞা। সাতের দশকের মাঝামাঝি শিল্পী বনাম রাজনীতিকের যে কুস্তি শুরু হয়েছিল, সেই কুস্তি আজও চলেছে।