অবশেষে তাঁর সন্ধান পাওয়া গেল। এতদিন কোথায় ছিলেন রবি কর ? জানা গেল, তিনি নাকি বুদ্ধিজীবী ম্যানেজমেন্ট স্কুল নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সাংবাদিকতায় তাঁর মন নেই, তিনি নাকি ভোটের আগে চ্যানেলে চ্যানেলে বুদ্ধিজীবী সাপ্লাই করতে চান। বিশ্বাস হচ্ছে না ? তাহলে, তাঁর মুখেই শুনুন।
রবি কর
যা দিনকাল পড়েছে না, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বহুজাতিক সংস্থার কর্মচারী, সবাইকে নিব্বংশ হয়ে মরতে হবে। নিব্বংশ- কারণ, যতই রোজগার করুক, গাড়ি-বাড়ি হাঁকাক, আগামি দিনে বিয়ের বাজারে এদের কেউ পাত্তা দেবে না। আর বিয়েই যদি করতে না পেলি, তাহলে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা কোন ভূতের বাবার শ্রাদ্ধে লাগবে শুনি?
একটু গুছিয়ে বলি। বেঙ্গল টাইমসে লিখে যা টাকা পাওয়া যায় তাতে সংসার চলে না। তাই ঠিক করেছি নতুন কিছু করব। এমন কিছু, যা কেউ কখনও করেনি, কিন্তু করলে সুপারহিট হবেই। অফিস থেকে মাস দুয়েক ছুটি নিয়ে নানান পরিকল্পনা করে শেষমেশ একটা মোক্ষম পথ খুঁজে পেয়েছি। আচ্ছা বলুন তো, আজকের দিনে বাঙালির সব থেকে বড় কেরিয়ার অ্যাম্বিশন কী? শিবরাত্রিতে বাঙালি যুবতী কেমন স্বামী কামনা করে ? কার্তিক পুজোর দিন তারা কেমন সন্তান চায় ? বছর কয়েক আগেও এর উত্তর ছিল সৌরভ গাঙ্গুলি। তার আগে উত্তমকুমার। তার আগে নেতাজি। কিন্তু ঠেকে শিখে বাঙালি বুঝেছে, নেতাজি-উত্তম-সৌরভ হতে গেলে বিস্তর খাটুনি। ননীর শরীরে অত পোষাবে না। বিনা খাটুনিতে রমণীকুলের মন জয় করার একটাই উপায়, বুদ্ধিজীবী হওয়া।
এমনিতে বাঙালি মায়ের পেট থেকে বেরিয়েই বুদ্ধিজীবী হয়। চায়ের দোকানে, মাছের বাজারে, কমনরুমে, ক্যান্টিনে, সর্বোপরি ফেসবুকে বুদ্ধিজীবী গিজগিজ করছে। কিন্তু পাড়ার বুদ্ধিজীবী হলে তো সমাজে কলকে পাওয়া যাবে না, হতে হবে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হলেন তাঁরা, যারা সকাল-বিকাল টিভিতে মুখ দেখান। যে কোনও বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য যাঁদের কোনও প্রস্তুতির দরকার হয় না, নিন্দুকে বলে বিষয়টি জানার প্রয়োজন হয় না, অন্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজের কথা বলতে যারা সুদক্ষ, হার নিশ্চিত জেনেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যারা হাঁউমাউ করে চেঁচাতে পারেন, তাঁরাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। সমাজে এই বুদ্ধিজীবীদের কী দাপট!! সুমিতবাবু মস্তবড় লোক, চাইলে দশজনকে চাকরি দিতে পারেন। কিন্তু পাড়ার টেঁপা মস্তান চাইলেই তাঁর মাথায় চাঁটা মারতে পারে। অথচ আমাদের সৃজন সরকার, সামান্য স্কুল মাস্টার, কেউ তাঁর গায়ে হাত তুলুক তো! হ্যায় কোই মায়ি কা লাল ? এই যে কলেজে, কলেজে অধ্যাপকরা এত মার খায়, নির্মলশঙ্করবাবু বা দেবপরায়ণবাবুকে কেউ কিছু বলে? বলে না, কারণ তাঁরা টিভিতে বসেন।
অর্থাৎ সকলেই চাইছে বুদ্ধিজীবী হতে, টি ভি-তে মুখ দেখাতে। প্রাইভেট টিউটর থেকে শুরু করে সিরিয়ালের নায়িকা, ব্যান্ডের গায়ক, পাড়ার জলসার চুটকিশিল্পী সবাই বুদ্ধিজীবী হওয়ার জন্য হেদিয়ে উঠেছে। ভেবে দেখলাম ‘মানুষ মানুষের জন্য। রবি কর বুদ্ধিজীবীদের জন্য’। মানে, যারা বুদ্ধিজীবী হতে চায় তাদের জন্য। পাড়াটে বুদ্ধিজীবী আর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর যেটুকু তফাত তা দূর করব আমি। আমি চালু করব দুনিয়ার প্রথম বুদ্ধিজীবী ম্যানেজমেন্ট কোর্স। আমার প্রতিষ্ঠানে যে কোনও বোকা-হাবাকে ঝাঁ চকচকে বুদ্ধিজীবীতে পরিণত করা হবে। তারপর তাদের টি ভি চ্যানেল, মেট্রো চ্যানেল, ইংলিশ চ্যানেল প্রভৃতি নানা জায়গায় সাপ্লাই করা হবে। একবার যদি এই পরিকল্পনা ক্লিক করে, বেঙ্গল টাইমসের মুখে নুড়ো জ্বেলে চলে যাব।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই পরিকল্পনা সফল হবেই। ভেবে দেখুন, পশ্চিমবঙ্গ হল মিডিয়ামাতৃক রাজ্য। এখানে চালু না হওয়া মিডিয়া চ্যানেলে কাজ করেও বছরের পর বছর মাইনে পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলায় ডজনখানেক নিউজ চ্যানেল। নামেই নিউজ চ্যানেল, খবর মেরে কেটে ৪ ঘণ্টা, বাকি ২০ ঘণ্টা বুদ্ধিজীবীদের বক্তিতে। মুশকিল হল, রাজ্যে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী মানে টিভি-বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মেরেকেটে ২০, অথচ ঘটনার শেষ নেই। একই লোক একবার এ-চ্যানেলে একবার ও-চ্যানেলে, একবার শশী থারুর নিয়ে, একবার শশী কাপুর নিয়ে আলোচনা করছেন। একে রাজ্য শিল্প নেই, এস এস সি, প্রাইমারি কোনও পরীক্ষাই হচ্ছে না। বেকার যুবকরা যাবে কোথায় ? কর্মসংস্থানের দিকটা ভেবে দেখুন। কোথায় কোথায় বুদ্ধিজীবীর কর্মসংস্থান হতে পারে, একটু বুঝে নেওয়া যাক।
১) ছোট, বড়, মেজো- প্রায় সব চ্যানেলেই বুদ্ধিজীবী লাগে। আগে ছোট চ্যানেল দিয়ে শুরু করে, একটু লবি করলেই বড় চ্যানেলের ডাক আসতে পারে। ২) রাজনৈতিক দলে বুদ্ধিজীবী প্রার্থীর একটা চাহিদা আছে। সব দলে যা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, আগামীদিনে সব দলই বুদ্ধিজীবীদের প্রার্থী করতে বাধ্য হবে। তাছাড়া, কয়েকবছর পরে বুদ্ধিজীবীদের জন্য আলাদা কোটা থাকতেই পারে। পাড়াটে বুদ্ধিজীবীরাও পঞ্চায়েত বা পুরসভায় টিকিট পেতে পারেন। ৩) মোমবাতি মিছিল, হোক কলরব, হোক চুম্বন- এমন কত সামাজিক আন্দোলন। এখানেও বুদ্ধিজীবীদের খুব চাহিদা। ৪) পুজো উদ্বোধনে বাজার বেশ ভাল, আগামীদিনে গৃহপ্রবেশেও বুদ্ধিজীবী লাগবে। ৫) বিয়ের কথা তো আগেই বলেছি, এমনকি প্রেমের ক্ষেত্রেও বুদ্ধিজীবীদের অগ্রাধিকার। ৬) সিনেমা, সিরিয়ালেও আগামীদিনে বুদ্ধিজীবীদের ডাক পড়বে।এই বাংলায় পোসেনজিতের থেকে শিক্ষক সৃজন সরকার কি কম জনপ্রিয় ? কিছু সিক্রেট থাকা দরকার। তাই, বাকি পরিকল্পনাগুলো আর বলছি না। তবে জেনে রাখুন, সেইদিন আসছে, যেদিন সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মতো, রণে বনে জলে জঙ্গলে সর্বত্রই বুদ্ধিজীবী দরকার পড়বে।
তাই বাজারে চাই নতুন বুদ্ধিজীবী। চাই বুদ্ধিজীবী তৈরির স্কুল। স্কুল বললে ব্যাপারটা ঠিক স্মার্ট হয় না। তাই ইনস্টিটিউশন বলাই ভাল। একইদিনে একসঙ্গে তিনটে চ্যানেলে দাপিয়ে বেড়ানোর প্রতিভাও কারও কারও আছে। তবে সবাইকেই তো সুযোগ দিতে হবে। তাই এখানেও একটা সিন্ডিকেট চালু করা যেতে পারে।
কিছু কিছু বিষয় নিয়ে অবশ্য সমস্যায় পড়েছি। যেমন আইনজীবী, সমাজকর্মী। আইনজীবী কাম বুদ্ধিজীবী হতে হলে আগে আইন পাস করতে হয়। অবশ্য, একটা ভরসার কথা, আইন পরীক্ষায় নাকি কেউ কখনও ফেল করে না। অন্তত এমন দুর্লভ প্রজাতির কোনও মানুষ আমার চোখে পড়েনি। যদি আপনাদের চোখে পড়ে, জানাবেন, এক বিরল প্রজাতির বুদ্ধিজীবী পাওয়া যাবে।
এদিকে সমাজসেবী ঠিক কারা এবং তাঁরা কোন সমাজের কী সেবা করেন সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মোটামুটি দেখা যায়, এরা সাদামাটা পোশাক পরে, এলোমেলো চুলে, চুপচাপ বসে থাকেন। বলার সুযোগ পেলে দাদা-দিদি-ভাই-ভাইপো- মাসি-মামা সবার নিন্দে করেন। সবাই ভুল। ঠিকটা যে কী তা নিজেরাও জানেন না। দেখি যদি এমন কাউকে পাওয়া যায়।
যদি কাউকে না পাই, নিজেই যাব। আমার থেকে বড় সমাজসেবি কে আছে? আমার এই স্কুল তৈরি হলে এতদিনকার বুদ্ধিজীবীদের ওপর থেকে কত চাপ কমে যাবে ভাবুন তো! বঙ্গসমাজ তখন তরতর করে এগিয়ে যাবে। তখন নাট্যকাররা মনের সুখে ‘স্বজনখামার’ পালার রিহার্সাল দিতে পারবেন, কবি মন দিয়ে চেয়ার মুছতে পারবেন, সৃজন সরকার বনের মোষ না তাড়িয়ে দুবেলা টিউশন করতে পারবেন, সর্বোপরি হিতব্রত এবং হতরূপ মন দিয়ে ফেসবুক করতে পারবে। আহা এই টি ভি চ্যানেলগুলোর জ্বালায় তারা একটু মার্কসবাদী কায়দায় ফেসবুক করতেও পারছে না। আমি না দেখলে তাঁদের কে দেখবে?
তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সদর দপ্তরে প্রার্থীপদ নিয়ে কোনও মারামারিই হবে না। লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত যে আসনে একাধিক দাবীদার সেখানেই বুদ্ধিজীবী প্রার্থী। উপরমহলের পাঠানো অতিথি প্রার্থী, সব গোষ্ঠীকে এক হয়ে কাজ করতেই হবে। আর আমার স্কুল ছাড়া এতো বুদ্ধিজীবী কোথায় পাবে পার্টিগুলো? সিন্ডিকেট শুনেছেন তো ? রড, বালি, সিমেন্ট সব তাদের কাছেই নিতে হবে। অন্য কোথাও নেওয়া চলবে না। সবকিছুর সিন্ডিকেট থাকলে বুদ্ধিজীবী সিন্ডিকেট হবে না কেন ? যার যত বুদ্ধিজীবা লাগবে, যে ক্যাটাগরির বুদ্ধিজীবী লাগবে, সব আমার স্কুল থেকেই নিতে হবে।
যাই হোক, বিশ্বাস করে আপনাদের সব বললাম। দেখবেন আমার আগে যেন আপনারা কেউ বুদ্ধিজীবী ইন্সটিটিউশন খুলে বসবেন না। তা হলে কিন্তু ফেসবুকে আপনার নামে যা তা লিখব। আদালত বলে দিয়েছে, ফেসবুকে লিখলে পুলিশে কিছু করতে পারবে না।